
নির্বাচনের সময় ও জাতীয় সংস্কার নিয়ে উচ্চপর্যায়ের সংলাপে সমঝোতার সম্ভাবনা
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসতে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শুক্রবার লন্ডনে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন। লন্ডনের দ্য ডরচেস্টার হোটেলে সকাল ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর এটি হবে উভয় পক্ষের প্রথম আনুষ্ঠানিক সংলাপ।
এই বৈঠক এমন একটি সময়ে হতে যাচ্ছে, যখন দেশজুড়ে নির্বাচন নিয়ে চরম বিভক্তি বিরাজ করছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে ছাত্রদের আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অধ্যাপক ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সেই সরকার ঘোষণা দিয়েছে, নির্বাচন হবে ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসে, তবে তার আগে জরুরি সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
অন্যদিকে, বিএনপি এবং অনেক নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি চাইছেন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। তাদের যুক্তি, রমজান, এইচএসসি পরীক্ষা এবং জনগণের চাপের কারণে নির্বাচন বিলম্বিত হলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়বে।
এই পটভূমিতে লন্ডনের এই বৈঠক বিশাল তাৎপর্য বহন করে। অনেকে মনে করছেন, এই সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত হতে পারে, এবং নির্বাচন নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে। একইসঙ্গে এটি হতে পারে সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে ভবিষ্যতের জন্য একটি সমঝোতামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা।
বৈঠকে আলোচনার প্রধান বিষয়গুলো হতে পারে — নির্বাচন কবে হবে, নির্বাচন পরিচালনায় নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, এবং চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার গতি ও কাঠামো। বিএনপির পক্ষ থেকে আশা করা হচ্ছে, তারা ইউনুসকে রাজি করাতে পারবেন যাতে নির্বাচন এপ্রিল ২০২৬-এর বদলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া তারা চাইবে নির্বাচন পরিচালনা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা এবং পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার নিশ্চয়তা।
অন্যদিকে, সরকারের দাবি হলো, নির্বাচন আগে হলে সংস্কারের মান খারাপ হবে। তারা ইতোমধ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, যারা বিচারব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, প্রশাসনিক কাঠামো এবং নির্বাচন ব্যবস্থার উপর কাজ করছে। এই কাজ সম্পন্ন না হলে নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।
এই বৈঠক একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক নতুন ধারা সূচনারও ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশে বিরোধীদলগুলোর মধ্যে সংলাপের সংস্কৃতি দীর্ঘদিন অনুপস্থিত। এই সংলাপ দেখাচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে, সমঝোতা ছাড়া কোনো পক্ষের জন্য সামনে এগোনো সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেছেন, “এই বৈঠক একটি রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি বার্তা দিচ্ছে যে, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব।” অন্য এক বিশ্লেষক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, “এই প্রথমবারের মতো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এবং বিএনপির শীর্ষ নেতার মধ্যে সরাসরি সংলাপ হতে যাচ্ছে। এখান থেকে যদি কোনো চুক্তি আসে, তার প্রভাব হবে দীর্ঘস্থায়ী।”
তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। দুই পক্ষের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। বিএনপি অতীতে অভিযোগ করেছে, তাদেরকে কোণঠাসা করা হয়েছে, এবং কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত যেমন জামায়াত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার — তারা একে সরকারের পক্ষপাতিত্ব হিসেবে দেখছে। একইভাবে, সরকারের পক্ষেও রয়েছে কিছু ‘রক্ষণশীল’ উপদেষ্টা, যারা নির্বাচন এগিয়ে আনাকে সংস্কারের ওপর আঘাত হিসেবে দেখছেন।
এই বৈঠকের আন্তর্জাতিক গুরুত্বও রয়েছে। বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর পর্যবেক্ষণ করছে। একটি শান্তিপূর্ণ, আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি হলে আন্তর্জাতিক মহলও আশ্বস্ত হবে। তবে কোনো সমঝোতা না হলে পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।
সবশেষে, ইউনুস–তারেক বৈঠক হয়তো একটি যৌথ রাজনৈতিক রূপান্তরের ভিত্তি গড়তে পারে, আবার হয়তো এটি একটি ব্যর্থ সুযোগ হিসেবেও চিহ্নিত হতে পারে। দুটি পক্ষই যদি নিজ অবস্থান থেকে কিছুটা ছাড় দেয়, তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ একটি নতুন ধারায় প্রবেশ করতে পারে।
সময় অল্প। সংস্কার ও নির্বাচনের ভারসাম্য রক্ষা করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে হলে, এই শুক্রবারের বৈঠক হতে পারে ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংলাপ।