
নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হলেও সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, স্বাস্থ্যবিধি মানা ও টিকা গ্রহণে জোর দিচ্ছে সরকার
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আবারও করোনাভাইরাস সংক্রমণের কিছুটা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে আশেপাশের কিছু দেশে নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতে সতর্কতা জোরদার করা হয়েছে। তবে এ পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত না হয়ে দায়িত্বশীল আচরণ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর।
তিনি বলেন, “করোনা আবারও কিছুটা বাড়লেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এখনই কোনো লকডাউনের প্রয়োজন নেই, বরং প্রয়োজন সঠিক আচরণ ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা।” তিনি জানান, করোনা মোকাবিলায় সরকার আগেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে এবং প্রতিটি স্তরে নজরদারি ও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১৭ লাখের বেশি কোভিড টিকার ডোজ সরবরাহ করা হয়েছে এবং আরও ১৪ লাখ ডোজ টিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে মজুত রয়েছে। টিকা কার্যক্রম চলমান রয়েছে, এবং যারা এখনও টিকার আওতায় আসেননি, তাদের দ্রুত টিকা গ্রহণে উৎসাহিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি, যারা বুস্টার ডোজ নেননি, তাদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় ডোজ দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সীমান্তবর্তী এলাকা, বিমানবন্দর, স্থলবন্দর এবং সমুদ্রবন্দরগুলোতে IHR (International Health Regulation) ডেস্কগুলোর তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। এসব ডেস্কের মাধ্যমে বিদেশফেরত যাত্রীদের স্ক্রিনিং, স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। যাত্রীদের থার্মাল স্ক্যানিং এবং উপসর্গ দেখা দিলে কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশনের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
স্বাস্থ্যের ডিজি বলেন, “আমরা ২৮ হাজার র্যাপিড কিট সংগ্রহ করেছি এবং ১০ হাজারের বেশি RT-PCR টেস্ট কিট সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলছে। উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রিপোর্ট করতে হবে এবং কেউ যেন আত্মগোপনে না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “জ্বর, হাঁচি, কাশি বা শরীরে ব্যথা অনুভব করলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। টেস্ট করাতে হবে এবং অন্যদের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন হলে নিজে থেকেই আইসোলেশনে যেতে হবে।”
এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আশেপাশের কয়েকটি দেশে করোনা সংক্রমণের যে তরঙ্গ উঠেছে, তা বাংলাদেশে এখনও বড় আকারে ধরা পড়েনি। তবে আশঙ্কা থেকে পুরোপুরি মুক্তি নেই, কারণ ভাইরাসটি নতুনভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে। নতুন ভ্যারিয়েন্টের বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব সম্পর্কে আরও গবেষণা প্রয়োজন। তাই সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে দেশের ভাইরোলজিস্ট ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মুহূর্তে জনসচেতনতা বৃদ্ধি সবচেয়ে জরুরি। কারণ মানুষ সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে করোনা নিয়ে তেমন সতর্কতা পালন করছে না। ফলে নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে যেসব এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ এবং যেখানে স্বাস্থ্যসেবা সীমিত—সেসব জায়গায় সুরক্ষা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।
অন্যদিকে, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা ইউনিটগুলো স্ট্যান্ডবাই অবস্থায় রাখা হয়েছে। যদি হঠাৎ সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়, তাহলে দ্রুত হাসপাতাল ব্যবস্থা সক্রিয় করা সম্ভব হবে। অক্সিজেন সাপ্লাই, ওষুধ মজুদ এবং চিকিৎসক-কর্মীদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানানো হয়।
এছাড়াও ডিজি জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ও গণপরিবহনে মাস্ক পরা, হাত ধোয়ার অভ্যাস এবং দূরত্ব বজায় রাখার বিধিনিষেধগুলো আবারও চালু করার বিষয়ে সুপারিশ করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচিও নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, “করোনা আমাদের কাছে নতুন নয়। আমরা এই ভাইরাসের সঙ্গে তিন বছর ধরে লড়াই করেছি এবং জয়ও পেয়েছি। এখন নতুন করে আতঙ্ক ছড়ানো নয়, বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে দায়িত্বশীল আচরণ করাই হবে আমাদের প্রধান অস্ত্র।”
অতীতে যে অভিজ্ঞতা থেকে সরকার পরিস্থিতি সামলেছে, এবারও সেই পথেই প্রস্তুতি নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। তাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর বারবার সাধারণ মানুষকে সচেতন থেকে দায়িত্ব পালন করার আহ্বান জানিয়েছে।
সবশেষে বলা হয়, দেশবাসীর প্রতি স্বাস্থ্য বিভাগের বার্তা—করোনাকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না, আবার অতিরিক্ত আতঙ্কেও ভুগা যাবে না। সতর্ক থাকুন, সচেতন থাকুন, নিয়ম মেনে জীবনযাপন করুন—এটাই এখন সবচেয়ে কার্যকর পন্থা।