
আন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জানিয়েছেন, ২০২৬ সালের নির্বাচন হবে সবচেয়ে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক; আওয়ামী লীগ সাময়িক স্থগিত, শেখ হাসিনার প্রত্যার্পণেও তৎপরতা চলছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জুলাই সনদ নিয়ে গণভোটের কোনো প্রয়োজন নেই, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত অংশগ্রহণ ও ঐকমত্যই এই রূপান্তর প্রক্রিয়াকে টেকসই করবে। ২০২৫ সালের ১১ জুন লন্ডনের চ্যাথাম হাউসে দেওয়া এক ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, “গণভোট অর্থহীন হবে,” কারণ জনগণ এমন জটিল কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়গুলো সবসময় সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে না। তিনি উল্লেখ করেন, যদি দেশের সব রাজনৈতিক দল এই আলোচনায় যুক্ত হয় এবং নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়, তবে সেটিই সবচেয়ে কার্যকর পথ। এ সময় তিনি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট, প্রশাসনিক সংস্কার, বিচারব্যবস্থা পুনর্গঠন ও নির্বাচন প্রসঙ্গে বিস্তারিত বক্তব্য দেন।

ড. ইউনূস বলেন, জুলাই মাসেই জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি “জুলাই সনদ” চূড়ান্ত করা হবে, যা হবে ভবিষ্যতের সংবিধান, নির্বাচন ও প্রতিষ্ঠান সংস্কারের রূপরেখা। এর ওপর ভিত্তি করেই ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসে একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি এটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে “সুন্দর ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” হিসেবে গড়তে চান। তবে নির্বাচন নিয়ে সময়সীমা নির্ভর করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত এবং মাঠ পর্যায়ের প্রস্তুতির ওপর। তাই নির্বাচন ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে হতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন।
জুলাই সনদ প্রস্তুতিতে যেসব রাজনৈতিক দল ইতিমধ্যেই অংশগ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে রয়েছে বিএনপি, জামায়াত, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, নাগরিক ঐক্য ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যার উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন অধ্যাপক আলী রিয়াজ, তারা এরইমধ্যে কয়েকটি পর্যায়ে খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে। ইউনূস জানান, সব আলোচনার ভিডিও জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে, যা গণতন্ত্রের একটি বড় উদাহরণ।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত রয়েছে, তবে ইউনূস একে কোনো নিষেধাজ্ঞা হিসেবে দেখতে চান না। বরং, তিনি বলেন, যারা জনগণকে প্রকাশ্যে হত্যা করেছে, গুম করেছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করেছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে। এই তদন্তের ভিত্তিতেই তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হবে। “তারা যদি তরুণদের রাস্তায় গুলি করে হত্যা করে, তাহলে তাদের কি রাজনৈতিক দল বলা যায়?” এমন প্রশ্ন রেখে তিনি রাজনৈতিক সহিংসতা এবং জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
একইসঙ্গে ইউনূস জানিয়েছেন, তিনি কিংবা তাঁর মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য ২০২৬ সালের নির্বাচনের পরে ক্ষমতায় থাকতে চান না। “আমাদের কাজ হচ্ছে একটি সুশৃঙ্খল ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করে জনগণের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। কেউ চিরস্থায়ীভাবে এখানে আসেনি,” বলেন তিনি। এটি তাঁর সরকারের একটি মৌলিক প্রতিশ্রুতি, যা আন্তর্জাতিক পরিসরেও স্বীকৃতি পাচ্ছে।
লন্ডন সফরে ইউনূস ব্রিটিশ রাজা চার্লস ও অন্যান্য কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং শেখ হাসিনার প্রত্যার্পণ প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও আলোচনা করেন। তিনি জানান, শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে রয়েছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ও ইন্টারপোলের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও, তিনি জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নারী অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁর ভাষায়, “আমরা নারী নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিচ্ছি, মন্ত্রিসভায় নারী সদস্য রয়েছেন এবং তারা সক্রিয়ভাবেই কাজ করছেন।”
অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে একটি আন্তর্জাতিক উৎপাদন হাবে পরিণত করার পরিকল্পনার কথাও জানান ইউনূস। তিনি বলেন, জ্বালানি, অবকাঠামো এবং আঞ্চলিক সংযুক্তিতে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছে, এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ইতোমধ্যেই বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ সময় তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ আজ রাজনৈতিকভাবে জাগ্রত। আমাদের কাজ তাদের আস্থার প্রতি সম্মান দেখানো।”
এই পুরো রূপান্তর প্রক্রিয়ার পেছনে রয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার, যা ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গঠিত হয়। এরপর গঠন করা হয় একাধিক সংস্কার কমিশন—যার মধ্যে সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন উল্লেখযোগ্য। ইতোমধ্যে অধ্যাপক আলী রিয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যেখানে নতুন একটি সংবিধান সভা গঠনের প্রস্তাব রয়েছে।
ড. ইউনূসের এই অবস্থান প্রমাণ করে যে তিনি গণভোট নয়, বরং রাজনৈতিক পরিপক্বতা এবং দলগুলোর সম্মিলিত অংশগ্রহণে বিশ্বাসী। এতে গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা নিশ্চিত হয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ এখন একটি সংকট থেকে সম্ভাবনার পথে হাঁটছে, যেখানে জুলাই সনদ হতে পারে জাতীয় পুনর্গঠনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।