
ঈদের ছুটি ধাপে ধাপে দিলে সড়ক দুর্ঘটনা ও যাত্রীদের দুর্ভোগ কমানো সম্ভব — যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরামর্শ
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে আসন্ন ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে জাতীয় ছুটি পুনর্বিন্যাস করার জন্য, যাতে ঘরমুখো মানুষের চাপ নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এবং সড়কে যানজট ও দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হয়। তারা ছুটির দিনগুলোকে অঞ্চল ও শিল্পখাত অনুযায়ী ধাপে ধাপে নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বিশেষভাবে তৈরি পোশাকশিল্প (RMG) খাতের শ্রমিকদের ছুটি আলাদাভাবে নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে, যেহেতু এই খাতের লাখ লাখ কর্মী ঈদের আগে গ্রামে ফেরেন।
সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, প্রতি ঈদেই আমরা মহাসড়কে একই ধরনের চিত্র দেখি—প্রচণ্ড যানজট, পরিবহন সংকট, অতিরিক্ত ভাড়া, এবং নানাবিধ ভোগান্তি। অথচ একটু পরিকল্পনা ও সময়সীমার ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছুটি দিলে এই দুর্ভোগ অনেকটা কমানো সম্ভব।
তিনি বলেন, “ঢাকায় কর্মরত প্রায় দুই কোটি মানুষ ঈদের সময়ে বাড়ি ফেরেন। এর মধ্যে প্রায় ৫০-৬০ লাখ মানুষ তৈরি পোশাকখাতে কাজ করেন। যদি এই শ্রমিকদের ছুটি ধাপে ধাপে দেওয়া হয়, তাহলে ঈদের ৪-৫ দিন আগে থেকে যাত্রা শুরু হতে পারে এবং শেষ হতে পারে ঈদের পরেও কয়েকদিন ধরে। এতে সড়কে চাপ অনেকটাই কমবে।”
যানজট ও দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশ
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, ঈদের সময় দেশের প্রধান মহাসড়কগুলোতে যানজট নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত যানবাহন, অপ্রশিক্ষিত চালক, ট্রাফিক পুলিশের অভাব, এবং রাস্তার পাশে বাজার বসানো—এসবই যানজটের মূল কারণ। এছাড়া, প্রতিবারই ঈদের সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ২০২৪ সালের ঈদুল আজহায় প্রায় ৩৭২টি দুর্ঘটনায় ৪৩৫ জনের বেশি মানুষ নিহত হন।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সংস্থাটি কিছু সুপারিশ করেছে:
-
অঞ্চলভিত্তিক ছুটি নির্ধারণ: সরকারি, বেসরকারি ও পোশাকশিল্পে কর্মরতদের জন্য ছুটি ধাপে ধাপে নির্ধারণ করা।
-
হাইওয়ে মনিটরিং টিম: রাস্তায় সিসিটিভি মনিটরিং, ট্রাফিক পুলিশ বৃদ্ধি এবং রাস্তায় মোবাইল কন্ট্রোল রুম স্থাপন।
-
জরুরি চিকিৎসা সহায়তা: প্রধান হাইওয়েগুলোতে অ্যাম্বুলেন্স ও মেডিকেল টিম মোতায়েন।
-
পর্যাপ্ত গণপরিবহন: বাস, ট্রেন ও লঞ্চের সংখ্যা বাড়ানো এবং আগাম টিকিট নিশ্চিত করা।
-
অতিরিক্ত ভাড়া রোধে ব্যবস্থা: বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা।
পরিবহন মালিক ও সরকারের ভূমিকায় সমালোচনা
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগের জন্য কেবল রাস্তার অবস্থা দায়ী নয়। পরিবহন মালিকরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন, মালিকপক্ষের অসহযোগিতার কারণে পরিবহন সংকট তৈরি হয়, এবং সরকারেরও দুর্বল পরিকল্পনার ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে এই সংকট ঘনীভূত হয়।”
তিনি আরও বলেন, ঈদের আগে-পরে মহাসড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতে মোবাইল টিম, পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি, এবং দুর্বল রাস্তা মেরামতের জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকা উচিত।
পোশাকশ্রমিকদের আলাদা পরিকল্পনার দাবি
প্রতিবছর তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিক ঢাকার আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে একযোগে বাড়ি ফেরেন। ফলে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার ও টঙ্গীর সড়কে প্রচণ্ড চাপ পড়ে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি চায় এই শ্রমিকদের জন্য পৃথক ছুটি ও আলাদা পরিবহন ব্যবস্থার ব্যবস্থা করা হোক, যাতে তারা ধাপে ধাপে ভ্রমণ করতে পারেন এবং তাদের ঈদযাত্রা নিরাপদ হয়।
মিডিয়া ও জনসচেতনতা
সমিতি মিডিয়া, সামাজিক সংগঠন, ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে যাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, এবং ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে জনগণকেও সচেতন থাকতে বলা হয়েছে।
উপসংহার
প্রতি ঈদেই দেশের সড়কগুলোয় দেখা যায় বিশৃঙ্খলা, যানজট, এবং অপ্রস্তুত ব্যবস্থাপনার চিত্র। যাত্রী কল্যাণ সমিতির এই আহ্বান বাস্তবায়ন করলে ঈদযাত্রা হতে পারে নিরাপদ, নির্বিঘ্ন ও শৃঙ্খলাপূর্ণ। সরকার যদি অঞ্চলভিত্তিক ছুটি এবং রুটিনভিত্তিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা চালু করে, তবে ভবিষ্যতের ঈদযাত্রাগুলো আরও আরামদায়ক ও প্রাণঘাতী দুর্ঘটনাহীন হতে পারে