
বুড়িগঙ্গা নদীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব
বুড়িগঙ্গা নদী একসময় ছিল ঢাকার প্রাণ। এটি শুধু একটি নদী নয়, বরং ঢাকার ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও জনজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এক জীবনধারা। এই নদীর তীরে দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছিল মুগল আমলের ঢাকা শহর। বাণিজ্যিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য নদীটি ছিল কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু আধুনিক ঢাকার অগ্রগতির পেছনে এই নদী যেভাবে অবদান রেখেছে, ঠিক উল্টোভাবে আজ সে শহরের অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দূষণ ও অবৈধ দখলের কারণে এই নদী ধ্বংসের মুখে পড়েছে।
বুড়িগঙ্গার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
মুগল শাসনামলে বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী এলাকায় গড়ে ওঠে ঢাকা। নদীর মাধ্যমে পণ্য পরিবহন, যোগাযোগ এবং শহরের দৈনন্দিন জীবনধারার সঙ্গে ছিল গভীর সম্পর্ক। সেসময় নদীটি ছিল পরিষ্কার, গভীর ও প্রাণবন্ত। এখান থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করা হতো, কৃষিকাজেও ব্যবহার হতো নদীর পানি। নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভ করেছিল, যা ঢাকার অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
দূষণের মূল কারণসমূহ
বুড়িগঙ্গা নদীর বর্তমান দূষণ একাধিক উৎস থেকে সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান কারণ হলো:
১. শিল্পবর্জ্য
বিশেষ করে হাজারীবাগ এলাকার ট্যানারি, প্লাস্টিক, ডাইং ও কেমিক্যাল কারখানাগুলোর বর্জ্য প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে সরাসরি বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে নেই কার্যকর ইটিপি। ফলে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নদীর পানিতে মিশে যায়, যা জলজপ্রাণী ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
২. গৃহস্থালি ও কঠিন বর্জ্য
ঢাকা শহরের ঘরবাড়ি, হোটেল, বাজার থেকে প্রতিদিন ফেলা হয় শত শত টন প্লাস্টিক, পচনশীল বর্জ্য ও ময়লা। এই বর্জ্য নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করে এবং পানিকে আরও দূষিত করে তোলে।
৩. মেডিকেল ও নর্দমার বর্জ্য
হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে উৎপন্ন সংক্রামক বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই নদীতে ফেলা হচ্ছে। পাশাপাশি ঢাকার অপরিশোধিত নর্দমার পানি সরাসরি বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ে। এতে পানিতে জীবাণু, বিষাক্ত পদার্থ ও জৈব দূষণ বৃদ্ধির কারণে নদীজল একেবারে অচল হয়ে গেছে।
অবৈধ দখল ও তার প্রভাব
নদীর দুই পাড় দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মার্কেট, ভবন, গুদাম, বসতবাড়ি ও ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব দখলদার বেড়িবাঁধ দিয়ে নদীর প্রাকৃতিক গতি রোধ করেছে। ফলে নদী সংকুচিত হয়ে পড়েছে এবং বর্ষাকালে আশপাশের এলাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতা ও বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি নগর ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত বিপর্যয়
দূষিত বুড়িগঙ্গার পানি মানুষের জন্য এক বিপজ্জনক বিষ। এই পানি ব্যবহার করে অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, পাকস্থলীর অসুখ ও দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণে। শিশু, বৃদ্ধ এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। নদীর আশেপাশের জমি ও বায়ুও বিষাক্ত হয়ে পড়েছে, ফলে কৃষি ও পশুপালন হুমকির মুখে।
প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব
সরকার বহুবার অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও দূষণ রোধে অভিযান চালালেও তা ছিল স্বল্পস্থায়ী। অপরাধীরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে শাস্তি এড়িয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় প্রশাসনের দুর্নীতি ও উদাসীনতা নদী সংরক্ষণের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে।
করণীয় ও সুপারিশ
পরিবেশবিদ ও নাগরিক সমাজের মতে, বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে অবিলম্বে নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া জরুরি:
-
অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা।
-
শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে ইটিপি স্থাপন ও নিয়মিত মনিটরিং।
-
মেডিকেল, গৃহস্থালি ও ড্রেনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন।
-
নদীর পাড়ে বৃক্ষরোপণ ও সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা।
-
পরিবেশ সংরক্ষণে কঠোর আইন প্রয়োগ ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা।
-
স্কুল-কলেজে পরিবেশ শিক্ষা চালু ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি।
উপসংহার
বুড়িগঙ্গা নদী যদি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তাহলে শুধু একটি প্রাকৃতিক জলধারা নয়, হারিয়ে যাবে ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। এর প্রভাব পড়বে পরিবেশ, অর্থনীতি ও মানুষের জীবনের উপর। তাই আজই সময় — সরকার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসন ও জনগণকে একসাথে এগিয়ে এসে বুড়িগঙ্গা রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বুড়িগঙ্গা থাকবে শুধু পাঠ্যবইয়ের একটি নাম হিসেবে — বাস্তবে নয়।