এনসিপি সমর্থনে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলে ঐক্যমত্যের আহ্বান করেন নাহিদ ইসলাম

সংবিধান সংস্কারে স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল অপরিহার্য: তিন বাহিনী প্রধান ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া আলাদা রাখার প্রস্তাব দেন এনসিপি আহ্বায়ক

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দিনের বৈঠক শেষে বুধবার (১৮ জুন) ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানান, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি)’ গঠনে তারা সম্পূর্ণ একমত। তিনি বলেন, “কাউন্সিলের ওপর রাষ্ট্রের সকল মহলের আস্থা থাকতে হবে। যারা বিরোধিতা করেছে, তাদের মতামতও আমরা শুনেছি; তবে দলের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।” এই মন্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট করেছেন যে, এনসিপির দৃষ্টি নতুন কাঠামো গঠন ও সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবনায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির ওপর নিবদ্ধ থাকবে ।

নাহিদ ইসলামের বক্তব্য অনুযায়ী, এনসিসি গঠন প্রসঙ্গে এনসিপি প্রস্তাব করেছে যে তিন বাহিনী প্রধান (থ্রি সার্ভিস চিফ) ও প্রধান বিচারপতিগণের নিয়োগ প্রক্রিয়া এই কাউন্সিলের বাইরে রাখা হোক। তাঁর যুক্তি, গুরুত্বপূর্ণ সংবিধানিক ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত পদে স্বতন্ত্র ও স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া বজায় রাখা জরুরি। এর ফলে সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীর স্বাধীনতা রক্ষা পাবে এবং বিচার বিভাগে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত থাকবে। পুরানো কাঠামোকে সমর্থন না করে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্য রাখতে ঐকমত্যের আহ্বান জানান তিনি। এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হল, কাউন্সিলে অন্তর্ভুক্তি বা পর্যালোচনার ক্ষেত্র যখন প্রাসঙ্গিক, তখন ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে মূল নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা রক্ষা করা ।

এদিকে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জুও জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি)’ না হলে রাষ্ট্র সংস্কার অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।” মঞ্জু আরও উল্লেখ করেন যে, এনসিসি প্রস্তাবে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বাদে বাকিরা একমত হয়েছে এবং আশা প্রকাশ করেন যে অবশিষ্ট দলেরাও শেষে ঐকমত্যে পৌঁছাবে। তিনি যুক্তি দেন, “নির্বাহী বিভাগের নামে নিয়োগে একক আধিপত্য থাকায় দলদাসের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে; এনসিসি বাস্তবায়িত হলে এসব নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছ পদক্ষেপ নিশ্চিত হবে, তবে প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া এতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না।” এই বক্তব্য থেকে লক্ষণীয় যে, রাজনৈতিক দলগুলো শাসন কাঠামোতে অংশগ্রহণ ও দায়িত্ব ও কর্তব্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ।

বৈঠকটি সকাল সাড়ে ১১টায় শুরু হয়, যেখানে প্রথম দিনের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামের প্রতিনিধি যোগ না দিলেও দ্বিতীয় দিনে তাদের তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল বৈঠকে অংশ নেয়। আলোচনায় জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, জেলা সমন্বয় কাউন্সিলসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত মতবিনিময় হয়। সেখানে অংশগ্রহণকারী নেতারা স্বচ্ছ নিয়মাবলি ও কাঠামো প্রণয়ের গুরুত্বে গুরুত্বারোপ করেন, যাতে সকল পক্ষ সন্তুষ্ট থাকে এবং শেষমেশ জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছানো সহজ হয় ।

প্রস্তাবিত কাঠামোর মধ্যে আলোচিত ছিল:

  • কাউন্সিল সদস্য নির্বাচন ও মেয়াদ: বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে কাউন্সিল গঠন এবং সদস্যদের মেয়াদ নির্ধারণ।

  • কার্যবিধি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া: খোলামেলা আলোচনা, মত বিনিময়, বিরোধী মনোভাবের সম্মান, মতবিবাদের পর্যাপ্ত সময় ও পদ্ধতি নিশ্চিতকরণ, যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আস্থা স্থাপন হয়।

  • সংবিধান সংশোধন স্তর: মৌলিক আইনি কাঠামো, মানবাধিকার সুরক্ষা, শাসনপ্রণালী ভারসাম্য, নির্বাচন পদ্ধতি, বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা, প্রশাসনিক নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়ের পর্যালোচনা।

  • নিয়োগ প্রক্রিয়া সংক্রান্ত নির্দেশিকা: নির্বাচন কমিশন ও সেনা-বাহিনী প্রধান নিয়োগে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি, তবে প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কাউন্সিলের বাইরে রাখা প্রস্তাব প্রণীত।

  • জনগণের অংশগ্রহণ: গণমত সংগ্রহ, রেফারেন্ডাম বা মতামত জরিপ, সেমিনার-ফোরাম, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জনগণের ভূমিকা নিশ্চিতকরণ।

  • প্রতিরোধ ব্যবস্থা: সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা রক্ষা, অপ্রয়োজনীয় দাপট রোধ, লবিস্টি প্রভাব এড়ানোর নিয়মাবলী।

  • সময়সীমা ও পর্যায়ক্রম: প্রাথমিক আলোচনা, মধ্যবর্তী প্রতিবেদন, চূড়ান্ত সুপারিশ উপস্থাপনার জন্য নির্দিষ্ট টাইমলাইন নির্ধারণ।

আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমন্বয় অন্যতম চ্যালেঞ্জ। ঐকমত্য ভিত্তিক জাতীয় কাউন্সিল এই সমন্বয় প্রক্রিয়াকে সহায়তা করলেও কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সুদক্ষ প্রশাসনিক প্রস্তুতি, তথ্যভিত্তিক গবেষণা, নাগরিক আস্থার রক্ষাকবচ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ।

সরকার ও নীতি-নির্ধারণী সংস্থা আশা করছেন, এনসিসি গঠিত হলে নীতিনির্ধারণ এবং প্রশাসনিক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাবে। তবে তা অর্জনের জন্য রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ, সময়মতো বৈঠক-আলোচনা ও অনুমোদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ জরুরি। পরবর্তী আইন প্রণয়ন এবং অনুমোদনের ক্ষেত্রে এই কাঠামো গাইডলাইন হিসেবে কাজ করবে, যেখানে সাংবিধানিক আদালত ও সামাজিক বিজ্ঞানীদের মূল্যায়নের ভূমিকা থাকবে।

এই প্রক্রিয়া শুধু দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, বরং জাতীয় স্বার্থে গ্রহণযোগ্য ও জনমতের প্রতিফলনকারী সংবিধান পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে গৃহীত একটি উদ্যোগ। অতীতে সংবিধান সংশোধন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে মতবৈষম্য দেখা গেছে; তবে এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাৎ ও প্রকাশ্য আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য গড়ার প্রয়াস সফল হলে পরবর্তী ধাপ হিসেবে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া সহজ হবে। এজন্য প্রয়োজন কার্যকর সমন্বয়, সময়সীমা রক্ষা, এবং স্বচ্ছতা রক্ষার ব্যবস্থাপনা।

উপসংহারে, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনে নাহিদ ইসলাম ও মজিবুর রহমান মঞ্জু’র মতামত স্পষ্ট করে, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্য অপরিহার্য। যদিও কাঠামোর চূড়ান্ত রূপরেখা ও নিয়মাবলী এখনও নির্ধারিত হয়নি, আগাম বৈঠক-আলোচনা ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে এগিয়ে চললে বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কর্মসূচি আরও শক্তিশালী ও গণতান্ত্রিক হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে

Related Posts

30 Charged in Abu Sayed Murder: Justice Process Begins Under ICT in 2025

July Charter 2025 in Limbo as Political Talks Stall Over Key Reforms

A large crowd gathers in Bangladesh as national attention grows around the July Charter 2025 political reform talks. The image reflects rising public interest and concern over delayed consensus among major parties on key constitutional changes.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You Missed

Rising Dengue Cases in Bangladesh: 42 Deaths and Nearly 10,000 Hospitalized in 2025

  • By Chris
  • June 30, 2025
  • 11 views

30 Charged in Abu Sayed Murder: Justice Process Begins Under ICT in 2025

  • By Chris
  • June 30, 2025
  • 35 views
30 Charged in Abu Sayed Murder: Justice Process Begins Under ICT in 2025

July Charter 2025 in Limbo as Political Talks Stall Over Key Reforms

  • By Chris
  • June 30, 2025
  • 45 views
July Charter 2025 in Limbo as Political Talks Stall Over Key Reforms

Iran Strongly Condemns Former US President Trump’s Claim of Saving Khamenei in 2025, Calls Remarks Disrespectful

  • By Chris
  • June 28, 2025
  • 64 views
Iran Strongly Condemns Former US President Trump’s Claim of Saving Khamenei in 2025, Calls Remarks Disrespectful

4 killed, 14 injured in bus-truck collision on Dhaka-Mawa Expressway

  • By Chris
  • June 28, 2025
  • 51 views
4 killed, 14 injured in bus-truck collision on Dhaka-Mawa Expressway

Bangladesh Election Commission Sets September Deadline for Poll Materials Procurement-

  • By Chris
  • June 27, 2025
  • 42 views
Bangladesh Election Commission Sets September Deadline for Poll Materials Procurement-