
প্রতিষ্ঠিত বাঙবন্ধুর প্রতিকৃতি থেকে সরে এসে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা দিক তুলে ধরলো নতুন মুদ্রা
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি দেশের মুদ্রার নতুন সিরিজ উন্মোচন করেছে, যা দেশের ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ইতিহাসকে নতুন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের অধিকাংশ টাকার নোটে প্রতিষ্ঠিত বাঙবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি থাকলেও এবার সেই প্রচলিত নিয়ম থেকে সরে এসে বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রতীক এবং জাতীয় ঐক্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই নতুন নোটগুলো আধুনিক এবং বহুমাত্রিক বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে দেশের মানুষ, তাদের সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গল্প বলা হয়েছে।
ঈদুল আজহার আগেই এই নতুন ডিজাইনের টাকার কিছু মূল্যমান যেমন ২০, ৫০ ও ১০০০ টাকার নোট চলতি অর্থনীতিতে আনা হয়েছে। ঈদের পর বাকি denominations যেমন ২, ৫, ১০, ১০০, ২০০ ও ৫০০ টাকার নতুন নোট প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে। দেশের মুদ্রার এই ব্যাপক পরিবর্তন আধুনিকায়ন এবং একসাথে জাতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে।
সবচেয়ে চোখে পড়ার বিষয় হলো, ৫, ১০, ১০০, ২০০ ও ৫০০ টাকার নোটগুলো থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে দেয়া হয়েছে। পরিবর্তে এই নোটগুলোতে দেখা যাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক এবং ভবন, যা দেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাষ্ট্রগঠনের গুরুত্ব তুলে ধরে।
প্রতিটি টাকার নোটের ডিজাইনেই দেশবাসীর গর্ব ও স্মৃতিচিহ্ন ফুটে উঠেছে। ২০০ টাকার নোটে রয়েছে ১৯৬৯ সালের জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতি, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা স্মরণ করায়। ৫০০ টাকার নোটে আছে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ভবনের ছবি, যা বিচার ও আইনের শাসনের প্রতীক। ১০০০ টাকার নোটে রয়েছে জাতীয় সংসদ ভবনের চিত্র, যা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের শক্ত প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
ছোট মানের টাকাগুলোতেও রয়েছে গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক অর্থ। ৫০ টাকার নোটে দেখা যায় বাংলাদেশের লড়াইয়ের সময়কার বিখ্যাত চিত্রকর জয়নুল আবেদিনের ‘সংগ্রাম’ চিত্রকর্ম, যা মুক্তিযুদ্ধের কষ্ট ও সাহসকে প্রকাশ করে। ১০ টাকার নোটে রয়েছে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের ছবি, যা দেশের ধর্মীয় ও স্থাপত্য ঐতিহ্যের অংশ। ৫ টাকার নোটে রয়েছে তারামসজিদের ছবি, যা তার মজাদার মসৃণ মজার কাঠামো দ্বারা পরিচিত। আর ২ টাকার নোটে রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের ছবি, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক।
এই নতুন নোটের ডিজাইন শুধু মাত্র বহিরাগত সৌন্দর্য নয়, বরং এর মধ্যে দেশের মানুষের ঐক্য ও সংগ্রামের গল্প জড়ানো রয়েছে। এটি একক ব্যক্তির প্রতিকৃতি থেকে দেশ ও জাতির সম্মিলিত ইতিহাসের প্রতিফলনে রূপান্তরিত হয়েছে। এতে শিক্ষার্থী, কর্মী ও সাধারন মানুষদের সংগ্রামের কাহিনী উঠে এসেছে, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি একটি বিবৃতিতে জানিয়েছেন, এই নতুন নোটগুলো “একটি জাতির আত্মার ছবি, যা সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ”। তিনি উল্লেখ করেন, এই নোটগুলো তরুণ প্রজন্মকে গর্বিত করবে এবং সবাইকে দেশের ইতিহাস ও মূল্যবোধ স্মরণ করিয়ে দেবে। বিশ্বব্যাপী অনেক দেশই তাদের মুদ্রার ডিজাইন আধুনিকায়নের মাধ্যমে তাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে, আর বাংলাদেশও সেই ধারায় অগ্রসর হয়েছে।
এই নতুন নোট প্রকাশের সময় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও অবকাঠামোগত অগ্রগতির যুগেও এসেছে। তাই এই ডিজাইনগুলো দেশের সামগ্রিক উন্নতি এবং সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরে। ব্যবহারিক দিক থেকেও এই নোটগুলো উন্নত সুরক্ষা ব্যবস্থা সহ তৈরি, যার মধ্যে রয়েছে উন্নত ওয়াটারমার্ক, হোলোগ্রাফিক ইলিমেন্টস এবং রঙ পরিবর্তনকারী কালি, যা নোটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত ইতিবাচক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নোটের ডিজাইন ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনা চলছে এবং অনেকেই এই পরিবর্তনকে দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। ঈদের আগে নতুন নোট বাজারে আসায় অধিকাংশ মানুষ সহজেই ব্যবহার শুরু করেছে।
কিছু সমালোচক বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে দেয়ায় তার প্রতি সম্মান হ্রাস পাবে, তবে সরকার ও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এটি কোনো ভাবেই বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্বকে অবমূল্যায়ন করার প্রচেষ্টা নয়। বরং মুদ্রার নকশায় বহুমাত্রিক জাতীয় ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ভবিষ্যতে জনসাধারণের মাঝে নতুন নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা চালাবে। এতে দেশবাসী দ্রুত নতুন নোটের সাথে পরিচিত হবে এবং মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকবে।
সংক্ষেপে, বাংলাদেশের নতুন মুদ্রা শুধু একটি ডিজাইনের পরিবর্তন নয়, এটি জাতির সংগ্রাম, ঐতিহ্য ও উন্নতির গল্প। এটি দেশবাসীর প্রতিদিনের জীবনে জাতীয় ঐক্য ও স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কাজ করবে। আগামীর প্রজন্ম এই নোটের মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেম ও ঐতিহাসিক বোধকে জাগ্রত করবে এবং দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে।