
সাবেক সংসদ সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী মমতাজের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে অভিযোগ; রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উত্তেজনা বাড়ছে
ঢাকা, ২২ মে ২০২৫ — মানিকগঞ্জ আদালত গত বৃহস্পতিবার (২২ মে) সাবেক সংসদ সদস্য ও জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমকে দুই আলাদা হত্যার মামলায় ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। ১২ মে রাতে ধানমন্ডি এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া মমতাজকে সকালে ঢাকা কাশিমপুর কারাগার থেকে মানিকগঞ্জ কোর্ট কারাগারে নেওয়া হয়। রিমান্ড মঞ্জুরির মাধ্যমে তদন্ত সংস্থাগুলো আশা করছে দ্রুত হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করা যাবে এবং দায়ীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
মামলার পটভূমি ও ঘটনার বিবরণ
মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে মামলা ২০২৪ সালের সিংগাইরের গোবিন্দল এলাকায় চারজনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা হয়। ওই ঘটনার তদন্তের অংশ হিসেবে তাকে আসামি করা হয়েছে। মামলাটি মানিকগঞ্জ সিনিয়র দায়রা ও জজ আদালতে বিচারাধীন, যেখানে বিচারক হিসেবে নিয়োজিত আছেন নূর হোসেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম গত ১৩ মে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু মমতাজের আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল ও জামিনের আবেদন করেন। শুনানিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জুয়েল রানা চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরবর্তীতে তা ৬ দিন পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
হত্যাকাণ্ডের বিশদ
ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায়। এই এলাকায় একটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলছিল। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়। ওই সময় মো. সাগর নামে এক ছাত্র আন্দোলনকারীকে গুলি করে আহত করা হয়। আহত সাগর পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের মা মোসা বিউটি আক্তার বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নামী ব্যক্তির পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আসামিদের নামও উল্লেখ করা হয়। মমতাজ বেগমের নাম উল্লেখ করা হয়েছে ৪৯ নম্বর এজাহারনামীয় আসামি হিসেবে।
মমতাজ বেগমের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়
মমতাজ বেগম দেশের একজন খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী, যিনি দীর্ঘদিন থেকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-২ আসনে নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন।
রাজনীতির পাশাপাশি মমতাজ বেগম তার সঙ্গীতজীবনে বিশেষ স্থান অধিকার করেছেন। বহু জনপ্রিয় গান এবং কন্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি দেশের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। তার এই সাংস্কৃতিক জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোকে অনেকেই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন।
মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া
মমতাজ বেগমের গ্রেফতারির পর থেকে মামলার তদন্ত ত্বরান্বিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, তারা আরও সাক্ষ্য সংগ্রহ করছেন এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য ব্যক্তিদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। মমতাজের রিমান্ডে থাকার মাধ্যমে তথ্য আহরণ ও তদন্ত প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে বলে তিনি জানান।
আইনজীবীরা অবশ্য মমতাজের নির্দোষতার দাবি করেন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাকে ফাঁসানো হয়েছে বলেও মত প্রকাশ করেছেন। রিমান্ডের মেয়াদ কমানোর চেষ্টা চলছে এবং তারা আদালতে জামিনের আবেদন করেছেন।
পুলিশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও প্রশাসনের বক্তব্য
মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশ জানিয়েছে, তারা মামলার তদন্ত ও মমতাজসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। আদালত ও তদন্ত সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে। মানিকগঞ্জ শহর ও আদালত এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।
তাদের ভাষ্য, তদন্ত প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে চলার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে এ ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে নয়, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
মমতাজ বেগমের গ্রেফতার ও মামলার পর থেকে রাজনৈতিক মহলে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আওয়ামী লীগ শাখাগুলো এই মামলাকে ন্যায়বিচারের অংশ বলে দাবি করলেও বিরোধী দলগুলো এটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছে। সামাজিক মাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা চলছে।
অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিল্পী মমতাজের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তারা বলছেন, মমতাজ একজন প্রতিভাবান শিল্পী ও রাজনীতিবিদ, তাকে অবিচারে ফেলা ঠিক হবে না।
মামলার ভবিষ্যৎ ও ন্যায়বিচারের আশা
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের মামলায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করা দরকার যাতে দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে, অন্যথায় মুক্তি প্রদান করা হবে।
মমতাজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন এবং প্রয়োজনীয় আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন। তাদের লক্ষ্য মমতাজের নির্দোষতা প্রমাণ করা।
তদন্ত সংস্থা বলছে, তারা সকল প্রমাণ বিশ্লেষণ করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে যাতে বিচার কার্যক্রম বাধাহীনভাবে এগোতে পারে।
উপসংহার:
মানিকগঞ্জে সাবেক সাংসদ ও কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমের রিমান্ড এবং হত্যাকাণ্ডের মামলাটি দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই মামলার সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচার দেশের আইনের শাসনের প্রতি জনসাধারণের আস্থা জোরদার করবে। একই সাথে এটি রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের শিক্ষা দেবে।
মমতাজের গ্রেফতারি ও মামলাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে নানা প্রভাব পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। জনমনে রয়েছে, বিচার না পেলে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হতে পারে। তাই এই মামলার দ্রুত এবং স্বচ্ছ সমাধান সকলের প্রত্যাশা।