
রাফাহ শহরে সহায়তা কেন্দ্রে ইসরায়েলি হামলা, নিহত ৩৬
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার রাফাহ শহরে শনিবার, ৭ জুন ২০২৫ ভোরবেলা একটি সহায়তা কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষমাণ সাধারণ মানুষের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী গুলি চালালে অন্তত ৩৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, এই মানুষগুলো সবাই খাদ্য সহায়তা নিতে এসে জড়ো হয়েছিলেন এবং নিহতদের মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরাও ছিলেন। গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF) পরিচালিত এই সহায়তা কেন্দ্রে সকালের দিকে হাজারেরও বেশি মানুষ খাবার সংগ্রহের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, সকাল ৭টার দিকে ইসরায়েলি সেনারা এলাকা ঘিরে ফেলে এবং কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই গুলি চালাতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং সাহায্যের আশায় জড়ো হওয়া মানুষগুলো আতঙ্কে দৌড়াতে শুরু করেন। কিন্তু অনেকেই গুলির কবলে পড়ে মারা যান, অনেকের শরীরে গুলির চিহ্ন দেখা গেছে। কেউ কেউ তখনও হাতে খাবারের থলে ধরে ছিলেন, কিন্তু সেই খাবার আর পৌঁছায়নি গন্তব্যে। আহতদের অনেকে রাফাহের নিকটবর্তী হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান। এই নির্মম ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো একে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং ঘটনাটি অবিলম্বে তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
yesterday news © Al Jazeera English. Report by Ibrahim Al Khalili. Used with permission. Watch original video on Al Jazeera.
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা সহায়তা কেন্দ্রের আশপাশে কিছু “সন্দেহজনক কার্যকলাপ” লক্ষ্য করেছিল এবং আত্মরক্ষার স্বার্থেই গুলি চালানো হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই দাবিকে ভিত্তিহীন ও অগ্রহণযোগ্য বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এক বিবৃতিতে বলেছে, “গাজার মতো একটি সংকটাপন্ন অঞ্চলে এমন একটি হামলা কেবল বেআইনি নয়, এটি স্পষ্টতই একটি যুদ্ধাপরাধ, যা আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।” ঘটনাস্থলে থাকা একজন স্বেচ্ছাসেবী সাংবাদিকদের বলেন, “আমি নিজ চোখে অন্তত ২০টি মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেছি। অধিকাংশের শরীরে গুলির চিহ্ন ছিল। সেখানে কেউ সশস্ত্র ছিল না, তারা শুধুই খাবারের আশায় এসেছিল।” রাফাহের সিভিল ডিফেন্স বিভাগ জানিয়েছে, GHF পরিচালিত সহায়তা কেন্দ্রটি ছিল একটি উন্মুক্ত স্থান, যেখানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হলেও কোনো রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা, প্রাথমিক চিকিৎসা সহায়তা বা জরুরি সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল না। এর ফলে হামলার সময় তা এক ধরণের মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছিল। নিরাপত্তার অভাব, অগোছালো ব্যবস্থাপনা এবং সংঘর্ষের শঙ্কার মধ্যেই এই সহায়তা কার্যক্রম চালানো হচ্ছিল, যার পরিণতিতে আজকের এই ভয়ানক প্রাণহানি।
এটি প্রথম কোনো সহায়তা কেন্দ্রে হামলার ঘটনা নয়। গত ১ ও ৩ জুন একই শহরের দুটি ভিন্ন সহায়তা কেন্দ্রে ইসরায়েলি হামলায় আরও ৫৮ জন বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। সেই ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি এখনও মানুষ ভুলতে পারেনি, এরই মধ্যে নতুন এই গণহত্যার ঘটনা রাফাহ শহরের মানুষের মনে ভয় ও ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, অভিজ্ঞতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে জর্জরিত সংস্থা GHF-এর মতো সংগঠনকে মানবিক সহায়তার দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে ইসরায়েল একদিকে আন্তর্জাতিক চাপে পড়তে না চাওয়ার কৌশল নিয়েছে, অন্যদিকে প্রাণহানির ঝুঁকিও বেড়েছে। এই সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড এবং সহায়তা কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সুরক্ষা নিশ্চিত না করাই এমন দুঃখজনক ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী।
ঘটনার পরপরই জাতিসংঘ মহাসচিব এক বিবৃতিতে জানান, “খাদ্য নিতে আসা নিরস্ত্র মানুষদের ওপর গুলি চালানো সম্পূর্ণ অমানবিক। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। গাজার মানুষ এমনিতেই দুর্ভিক্ষ, অবরোধ, ওষুধ ও চিকিৎসার অভাবের মধ্যে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে খাদ্য সহায়তার স্থানেও যদি মৃত্যু অপেক্ষা করে, তাহলে তা আমাদের বিবেককে জাগিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট।” তুরস্ক, কাতার, মালয়েশিয়া, পাকিস্তানসহ অনেক মুসলিম দেশ এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কেবল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, ঘটনাটি তদন্ত করা হবে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান কূটনৈতিক চাপ বা পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি, যা বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
বর্তমানে গাজা এক গভীর মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। অবরোধের কারণে খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং জ্বালানির তীব্র সংকট চলছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার ২২ লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ১৮ লাখ মানুষ এখন সরাসরি মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। রাফাহসহ অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, দিনে একবেলা খাবার জোটাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি এবং রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সতর্ক করে বলেছে, যদি শিগগিরই আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রবেশ না করে, তাহলে শিশু মৃত্যুহার আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে পারে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। শুধু বিবৃতি নয়, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। যুদ্ধবিরতির আহ্বান যতদিন বাস্তব রূপ না নেবে, ততদিন গাজার সাধারণ মানুষ রক্ত ও কান্নার মধ্যেই দিন কাটাতে বাধ্য হবে। এই পরিস্থিতিতে গাজার অনেক মানুষই হতাশায় বলছেন, “আমরা কি শুধুই মরার জন্য বেঁচে আছি?” যখন সহায়তা কেন্দ্রেও নিরাপত্তা নেই, তখন গাজার ভবিষ্যৎ যে কতটা অন্ধকার—তা আর আলাদা করে বলার কিছু নেই। এখন সময় এসেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সোচ্চার ভূমিকা গ্রহণের, যেন নিরীহ মানুষের রক্ত আর না ঝরে।