
ঈদ বোনাস ও বেতন-ভাতার দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন: শ্রম মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি
ঢাকা, ২৩ মে:
ঈদুল আজহার আগে বোনাস ও বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের পোশাক খাত। রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শুক্রবার (২৩ মে) সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত এক পতাকা র্যালি শেষে শ্রমিক নেতারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ঈদের আগেই বেতন-বোনাস না দিলে শ্রম মন্ত্রণালয় ঘেরাও করা হবে।
ঈদ আসলেই বাড়ে চাপ, শুরু হয় টালবাহানা
প্রতিবছর ঈদের সময় গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ যেন এক নিয়মে পরিণত হয়েছে। শ্রমিক নেতারা বলেন, প্রতি বছর ঈদ এলেই মালিকপক্ষ নানা অজুহাতে বেতন ও বোনাস পরিশোধে সময়ক্ষেপণ করে। অথচ তারা সরকারি নানা সুবিধা যেমন ভ্যাট ছাড়, রফতানি প্রণোদনা এবং সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পেয়ে থাকে। এসব সুবিধা গ্রহণ করলেও শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে তারা ব্যর্থ।
নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ঈদের মতো একটি আনন্দঘন সময়েও শ্রমিকরা পরিবার নিয়ে শান্তিতে উৎসব পালন করতে পারেন না। বেতন-বোনাসের অনিশ্চয়তায় শ্রমিকদের মধ্যে যে মানসিক চাপ তৈরি হয়, তার দায় কে নেবে?”
শ্রমিকদের ৪ দফা দাবি
এদিন অনুষ্ঠিত পতাকা র্যালিতে অংশ নেওয়া শ্রমিক সংগঠনগুলো চার দফা দাবি উত্থাপন করে। দাবিগুলো হলো:
-
২০ রমজানের মধ্যে বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধ
-
সমস্ত বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ নিশ্চিত করা
-
কারখানাভিত্তিক তদারকি কমিটি গঠন করে মনিটরিং চালু
-
শ্রমিকদের জন্য সর্বনিম্ন মজুরি নিশ্চিত করা
এই দাবিগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেতারা বলেন, “শ্রমিকের ঘামে আজ দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে, অথচ তার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই।”
সরকারি হস্তক্ষেপের আহ্বান
বক্তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “সরকার যদি শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই খাতের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়বে।” তারা বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী, বোনাস ও বেতন ঈদের সাত দিন আগেই পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেই আইন মানা হয় না।
শ্রম মন্ত্রণালয়কে এই ইস্যুতে সরাসরি তদারকির আহ্বান জানিয়ে শ্রমিকরা বলেন, “যদি এবারও মালিকরা শ্রমিকদের পাওনা না দেয়, তাহলে শ্রম মন্ত্রণালয়কেই দায় নিতে হবে।”
কারখানায় চাপ ও মজুরি বৈষম্য
শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, অনেক কারখানায় কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তার বিনিময়ে বাড়তি মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া একই কাজ করেও পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি বৈষম্য রয়েছে। এমন বৈষম্য ও অনিয়ম দূর করতে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ দাবি করেন তারা।
অতীত অভিজ্ঞতা ও বর্তমান বাস্তবতা
পূর্ববর্তী ঈদগুলোতে দেখা গেছে, অনেক শ্রমিক শেষ মুহূর্তেও বোনাস না পেয়ে বাড়ি ফিরতে পারেননি। অনেকে উৎসবের দিনেও কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান ঈদের ঠিক আগের দিন কর্মীদের বেতন ও বোনাস না দিয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।
এবারও সেই আশঙ্কা থেকেই শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। তারা মনে করছেন, আগেভাগেই চাপ সৃষ্টি না করলে মালিকরা যথাসময়ে পাওনা পরিশোধ করবে না।
বিজিএমইএ’র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
বিজিএমইএ (বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন) দাবি করে থাকে, তারা সদস্য কারখানাগুলোকে সময়মতো বেতন-বোনাস পরিশোধের নির্দেশনা দিয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, বিজিএমইএ কেবল মৌখিক নির্দেশনা দেয়, তার বাস্তবায়নে কোনো নজরদারি নেই।
শ্রম মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচির ইঙ্গিত
শ্রমিক নেতারা স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “যদি ২০ রমজানের মধ্যে বেতন-বোনাস না দেওয়া হয়, তাহলে আমরা বৃহত্তর কর্মসূচি নেব, যার প্রথম ধাপে শ্রম মন্ত্রণালয় ঘেরাও হবে।” তারা দাবি করেন, শুধু হুমকির মাধ্যমে নয়, বাস্তবে আন্দোলন করে নিজেদের দাবি আদায় করতেই হবে।
উপসংহার
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত হলেও এখানকার শ্রমিকরা বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষিত। ঈদ সামনে আসতেই তাদের আন্দোলনের ডাক একটি অন্ধকার বাস্তবতারই প্রতিফলন। সময় এসেছে, মালিকপক্ষ, সরকার ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে একটি স্থায়ী সমাধানে পৌঁছানোর।
শ্রমিকের হাসিই দেশের উন্নয়নের সূচক—এই কথাটির বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব, যখন তাদের ন্যায্য পাওনা ও সম্মান নিশ্চিত হবে।