
৫৯৭টি দুর্ঘটনায় ১,১৯৬ আহত; মোটরসাইকেল ও পথচারী ঝুঁকি, ঢাকার উচ্চ হার ও মাল্টি-মোডাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার সংকটে দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি (Jatri Kalyan Samity) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের মে মাসে সারা দেশে মোট ৫৯৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৬১৪ জন নিহত এবং ১,১৯৬ জন আহত হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে সড়ক নিরাপত্তা এখনও বাংলাদেশের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ
। এ মাসে মোট দুর্ঘটনার মধ্যে মোটরসাইকেল সংযোগিত দুর্ঘটনা ছিল ২৩৩টি, যেখানে ২৫৬ জন নিহত ও ২০১ জন আহত, যা মোট দুর্ঘটনার ৩৯% এবং মোট নিহতের ৪১.৭%েরও বেশি অংশ দখল করে
। এই অনুপাত ইঙ্গিত দেয় যে দ্রুত বর্ধনশীল মোটরসাইকেল ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রিত অবকাঠামোর অভাবে কী পরিমাণ ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ঢাকা বিভাগ মে মাসে সর্বোচ্চ ১৩৯টি দুর্ঘটনা এবং ১৪৮ জন নিহত ও ২৭১ জন আহতের ঘনত্ব দেখায়, যেখানে জনসংখ্যা এবং যানবাহনের ঘনত্বের কারণে উচ্চ ঝুঁকি স্পষ্ট হয়েছে
। অন্যদিকে বরিশাল বিভাগে ৩০টি দুর্ঘটনায় ৩০ জন নিহত ও ৪৪ জন আহত হয়ে এটি সর্বনিম্ন সংখ্যা গণনা করলেও নিহতের অনুপাত চোখে পড়ার মতো, যা ইঙ্গিত দেয় যে প্রত্যেকটি দুর্ঘটনাই উচ্চ প্রাণহানির প্রবণতা বহন করে
।
সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি মে মাসে ৪৮টি রেলসংক্রান্ত দুর্ঘটনায় ৩৫ জন নিহত ও ১৪ জন আহত এবং ৭টি জলপথের দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত ও ১০ জন নিখোঁজ হয়েছে, যা দেখায় যে মাল্টি-মোডাল পরিবহন নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় আরও গুরুত্বীতা দিতে হবে
। হতাহতদের মধ্যে ৯২ জন ছাত্র, ১৫৪ জন চালক, ১০৩ জন পথচারী এবং ৬৭ জন পরিবহন কর্মী ছিল, যা নির্দেশ করে যে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষই ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন এবং বিশেষ করে পথচারী ও শিক্ষার্থীদের সড়ক পারাপার ও চলাচলের নিরাপত্তা দ্রুত উন্নত করতে হবে
। চালক ও পরিবহন কর্মীদের ক্ষেত্রে দীর্ঘ ঘণ্টা কাজ, অভিজ্ঞতার ঘাটতি, যানবাহনের অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি কারণ সুযোগ করে দেয় দুর্ঘটনার প্রবণতা বাড়তে।
মাসিক এই পরিসংখ্যান ২০২৪ সালের সামগ্রিক প্রতিবেদনেও দেখা যায় যে গত বছর বাংলাদেশে ৬,৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮,৫৪৩ জন নিহত এবং ১২,৬০৮ জন আহত হয়েছিল
। মোটরসাইকেল-সংযোগিত দুর্ঘটনা ২,৩২৯টি দুর্ঘটনায় ২,৫৭০ জন নিহত ও ৩,১৫১ জন আহত করেছিল, যা মোট দুর্ঘটনার ৩৬.৬% এবং নিহতের ৩০% এর বেশি
। এ তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ, লাইসেন্সিং এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন না করলে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হতে পারে। রেলখাতেও প্রতিবছর ৪৯৭টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন নিহত এবং ৩১৫ জন আহত হচ্ছিল, আর জলপথে ১১৮টি দুর্ঘটনায় ১৮২ জন নিহত ও ২৬৭ জন আহত, যা পরিবহন নিরাপত্তার বৃहत পরিপ্রেক্ষিতে সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে
।
সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে যুক্ত হয়: অনিয়ন্ত্রিত মোটরসাইকেল অপারেশন, অনুপযুক্ত বা অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য যানবাহন, দুর্বল সড়ক নকশা ও রক্ষণাবেক্ষণ, অপর্যাপ্ত সাইনেজ-লাইটিং, অপর্যাপ্ত চালক প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স অগ্রহণযোগ্য পদ্ধতি, দ্রুতগতিতে চালনা, ওভারটেকিংয়ের সময় নিরাপত্তা মেনে না চলা, এবং যানবাহন-পরীক্ষার দুর্নীতি। এসব কারণ মোকাবেলার জন্য জাট্রী কল্যাণ সমিতি নিয়মিত সুপারিশ দেয়: হেলমেট ও সীটবেল্ট আইন কঠোর প্রয়োগ, বদলতি যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, প্রধান সড়কে ছোট যানবাহনের চলাচল সীমিতকরণ, নিরাপদ ও সুসংহত সড়ক নকশা, পথচারী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশপাশে নিরাপদ দূরত্ব ব্যবস্থা, রোড সেফটি অ্যাক্ট প্রণয়ন ও দ্রুত বাস্তবায়ন, চালক প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সিং মান উন্নয়ন, এবং বাস্তবায়ন তদারকি বৃদ্ধি
। আরও বলা হয়, সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি, স্বচ্ছ মনিটরিং মেকানিজম এবং দায়িত্বশীল সংস্থার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমানেও কিছু প্রশাসনিক উদ্যোগ চালু হয়েছে—যেমন অতিরিক্ত ট্রাফিক সংকেত ও মার্কিং, অস্বাস্থ্যকর বা অপর্যাপ্ত যানবাহনের উপর মাঝে মধ্যে অভিযান—কিন্তু মাসিক ৫০০+ প্রাণহানির পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দেয় যে একক উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। একটি সমন্বিত, ডেটা-চালিত ও বহুমাত্রিক উদ্যোগ প্রয়োজন, যেখানে সরকারী সংস্থা, আইন প্রয়োগকারী, বেসরকারি পর্যবেক্ষণকারী সংগঠন ও জনসম্পৃক্তি সংস্থা মিলিত হয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করবে এবং প্রগতির স্বচ্ছ প্রতিবেদন দেবে। উদাহরণস্বরূপ, দুর্ঘটনা হতে প্রবণ হটস্পট সনাক্ত করতে জিআইএস মানচিত্র ও কেন্দ্রীয় দুর্ঘটনা ডেটাবেস ব্যবহার, অটোমেটেড স্পিড ক্যামেরা লাগানো, মোটরসাইকেল লেনের প্রকল্প বাস্তবায়ন, স্কুল-আশেপাশে নিরাপদ পথ ব্যবস্থা, ও জরুরি চিকিৎসা সেবা দ্রুত পৌঁছানোর ব্যবস্থা সড়ক মৃত্যুহার কমাতে সহায়ক হবে
।
রেল ও জলপথ নিরাপত্তাও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। মে মাসে রেলের ৪৮টি দুর্ঘটনায় ৩৫ জন প্রাণ হারিয়ে; জলপথে ৭টি দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত ও ১০ জন নিখোঁজ হওয়া ইঙ্গিত দেয় যে ট্রেন ও নৌযান রুটের নিরাপত্তা প্রোটোকল, স্তরের ক্রসিং, যানবাহন-পরীক্ষা, ও ক্রু প্রশিক্ষণ উন্নত করতে হবে
। একীভূত পরিবহন নিরাপত্তা নীতিতে এসব মোডকে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পদ বরাদ্দ ও মনিটরিং করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ব্যাপক: পরিবারে প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা গেলে পরিবার অর্ধেক শূন্যে পড়ে, চিকিৎসার খরচ ও মানসিক ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী হয়। নিম্ন-আয়ের পরিবারগুলোর জন্য সড়ক পরিবহন প্রধান চলাচলের মাধ্যম হওয়ায় ঝুঁকি আরও গুরতর। তাই নিরাপত্তা উন্নয়ন একটি সামাজিক ন্যায়ের বিষয়ও বটে।
ভবিষ্যতে ডিজিটাল টুলস যেমন কেন্দ্রীয় দুর্ঘটনা ডেটাবেস, জিআইএস হটস্পট ম্যাপিং, প্রেডিক্টিভ অ্যানালিটিক্স ব্যবহার করে হটস্পট নির্ধারণ এবং তদনুযায়ী সর্তকতা প্রচার ও অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ নিতে হবে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মনিটরিং সেলের সাথে সমন্বয় করে তাৎক্ষণিক ও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে পারলে নীতি নির্ধারণ আরও কার্যকর হবে। নিয়মিত প্রগতির প্রতিবেদন প্রকাশে জনসচেতনতা ও বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হবে, যেমন “বার্ষিক ১০% মৃত্যু হার হ্রাস” ধরণের লক্ষ্য নির্ধারণ ও পরিমাপযো
গ্য সূচক।
সার্বিকভাবে, মে ২০২৫-এ ৬১৪ জনের মৃত্যুহার ও ১,১৯৬ জনের আহতের পরিসংখ্যান, পাশাপাশি রেল ও জলপথ দুর্ঘটনার প্রাণহানি, তাত্পর্যপূর্ণ রোড সেফটি সংস্কার অপরিহার্য প্রমাণ করে
। বাংলাদেশ সরকার, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত উদ্যোগে দ্রুতগতিতে কার্যকর নীতি ও অবকাঠামো উন্নয়ন, কঠোর আইন প্রয়োগ ও স্বচ্ছ মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয় এবং অপ্রয়োজনীয় প্রাণহানি রোধ করা যায়।