
ড. শামসুল আলম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ২০২১ সালের জুলাই মাসে টেকনোক্র্যাট কোটায় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান এবং ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন। এর আগে তিনি ৩৫ বছরের বেশি সময় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন এবং পরে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য হিসেবে পরিকল্পনা কমিশনে সিনিয়র সচিব পদে দায়িত্ব পালন করেন। তার তত্ত্বাবধানে সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরি হয়, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের রূপরেখা নির্ধারণে সহায়ক ছিল।
তার গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং প্রশাসনিক মহলে আলোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকেই বলছেন, এ ধরনের একজন উচ্চপদস্থ সাবেক নীতিনির্ধারকের গ্রেফতার নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ এবং এটি হয়তো প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের প্রতীক হতে পারে। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণের চেষ্টা চলছে।
ডিবি সূত্র জানায়, সকাল ১১টা ৩৪ মিনিটে তাকে তার বাসা থেকে শান্তিপূর্ণভাবে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের সময় কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশের মিন্টো রোডের কার্যালয়ে, যেখানে তাকে বিস্তারিতভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা জানান, তাকে একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তবে মামলার বিষয়ে তদন্ত চলমান থাকায় এর বিস্তারিত তথ্য এখনই প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, গ্রেফতারের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিকে আদালতে হাজির করতে হয়। ডিবি কর্মকর্তারা জানান, আজ বিকেলেই তাকে আদালতে তোলা হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে রিমান্ড চাওয়া হতে পারে। যদি রিমান্ড মঞ্জুর হয়, তবে তদন্তের প্রয়োজনে তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ পাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অন্যদিকে, আদালত চাইলে তাকে কারাগারে পাঠাতে বা জামিন দিতে পারেন।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের একটি অংশ মনে করছে, এটি আইন অনুযায়ী স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। তাদের মতে, কেউ অপরাধ করলে তিনি যত উচ্চপদস্থই হোন না কেন, আইনের মুখোমুখি হতেই হবে। অন্যদিকে, সরকারের সমালোচকরা মনে করছেন, এই গ্রেফতার হয়তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিশেষ করে নির্বাচনের পরবর্তী সময় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নতুন গতিপ্রবাহের মধ্যে এই ধরণের পদক্ষেপ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, “অর্থনীতির নীতিনির্ধারকদের এভাবে গ্রেফতার দৃষ্টিকটূ এবং প্রশাসনিকভাবে হতাশাজনক।” অন্যদিকে অনেকে মনে করেন, “এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে, দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এখন সত্যিকারের শূন্য সহনশীলতা (zero tolerance) নীতি কার্যকর হচ্ছে।”
যদিও এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না ড. শামসুল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রকৃতি কী, তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই গ্রেফতার সরকারের একটি বার্তা বহন করে। বার্তাটি হলো—প্রাক্তন মন্ত্রী হলেও কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। একই সঙ্গে এটাও বলা যায়, এই ঘটনা দেশের প্রশাসনিক সংস্কার এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রাখা একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিকে গ্রেফতার দেখানোর ঘটনা বিরল। অতীতে এ ধরনের ঘটনা গুটিকয়েক ঘটেছে। যদি ড. শামসুল আলমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়, তবে তা দেশের অর্থনৈতিক প্রশাসনের ওপর আস্থা হ্রাস করতে পারে। আবার যদি অভিযোগ ভিত্তিহীন হয়, তবে তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নজির হিসেবে দেখা যেতে পারে।
বর্তমানে ড. শামসুল আলম মিন্টো রোডস্থ গোয়েন্দা কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। তদন্তের অগ্রগতি অনুসারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আজ আদালতে হাজির করার পর মামলার বিষয়ে আরও তথ্য প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার আইনজীবী বা পরিবারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সাধারণ জনগণ এ ঘটনার পরবর্তী ধাপের দিকে গভীরভাবে নজর রাখছে।
এই গ্রেফতার কেবল একজন সাবেক মন্ত্রীর আইনি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার বিষয় নয়, বরং এটি দেশের প্রশাসনিক কাঠামো, রাজনৈতিক পরিবেশ এবং নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সম্পর্কেও নতুন করে ভাবার সুযোগ তৈরি করেছে