
রংপুরে যৌতুকের কারণে স্ত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা, পুলিশ মামলা নিতে চায়নি |
রংপুর মহানগরীর মাহিগঞ্জ এলাকায় ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে স্তম্ভিত হয়ে গেছে স্থানীয় জনতা। ৮ জুন ২০২৫, রেজওয়ানা নামের এক ২২ বছর বয়সী গৃহবধূকে যৌতুকের দাবিতে পুড়িয়ে হত্যা করেছে তার স্বামী আবদুল করিম ও তার পরিবারের সদস্যরা—এমনটাই অভিযোগ নিহতের পরিবারের। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন ধরে আবদুল করিম তার স্ত্রী রেজওয়ানার পরিবারের কাছ থেকে বাড়তি যৌতুকের দাবিতে চাপ দিচ্ছিল। সেই চাপ মেনে না নেওয়ার কারণেই রেজওয়ানাকে পুড়িয়ে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা ঘটানো হয়।
রেজওয়ানার বাবা জানান, ঘটনার দিন তিনি নিজেই বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ তিনি মেয়ের কান্না ও চিৎকার শুনতে পান, কিন্তু ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো ছিল বলে তিনি ঢুকতে পারেননি। পরে আশেপাশের প্রতিবেশীরা এসে দরজা ভেঙে রেজওয়ানাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। শরীরের অধিকাংশ অংশ পুড়ে যাওয়ায় সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে ১৪ জুন ভোররাতে মারা যান রেজওয়ানা।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ
এই ঘটনার পর নিহতের পরিবার যখন রেজওয়ানার মরদেহ নিয়ে থানায় যায় এবং মামলা দায়ের করতে চায়, তখন পুলিশ মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায় বলে অভিযোগ উঠে। মাহিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল কুদ্দুস reportedly বলেন, “এটা আত্মহত্যা হতে পারে। আত্মহত্যা মামলা চাইলে আদালতে যান।” বিষয়টি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান রেজওয়ানার আত্মীয়রা। তাদের অভিযোগ, অভিযুক্তরাও অ্যাম্বুলেন্সে ছিল, কিন্তু পুলিশ তাদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ না করেই ছেড়ে দেয়। পরে গণচাপ ও সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনজনকে আটক করা হয়।
রেজওয়ানার চাচা মোনির হোসেন বলেন, “আমরা থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিই, কিন্তু তারা বারবার অভিযোগে ভুল আছে বলে সময় ক্ষেপণ করে। পরে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর, পুলিশ বাধ্য হয়ে মামলা নেয় ও অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করে।”
ওসি কুদ্দুস অবশ্য দাবি করেন, “অভিযোগে কিছু ভুল থাকায় মামলা নিতে দেরি হয়েছে।” তবে প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশ কীভাবে তদন্ত শুরুর আগেই ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে ধরে নিল? এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দেননি। এমনকি একজন নারী যখন পরিবারে নির্যাতনের শিকার হন, তখন পুলিশের এইরকম মনোভাব সমাজে আইন ও বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হ্রাস করে।
যৌতুকের ভয়াবহতা ও বিচারহীনতার পরিণতি
বাংলাদেশে “যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮” থাকা সত্ত্বেও এখনো প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে গ্রামীণ বা শহরতলির এলাকায় নারীরা এখনো যৌতুকের বলি হচ্ছেন। রেজওয়ানা ছিলেন তার পরিবারে একমাত্র মেয়ে, আর তাই বিয়ের সময় স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু আবদুল করিমের পরিবার একাধিকবার অতিরিক্ত অর্থ ও গহনা দাবি করে। এতে রাজি না হওয়ায় শুরু হয় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, যার শেষ পরিণতি হলো এই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড।
স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন এবং নারী অধিকারকর্মীরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। রংপুরের নারী অধিকার সংগঠন ‘সেফ উইমেন রাইটস’ এর সদস্য সুলতানা নাসরিন বলেন, “প্রতিদিন আমরা গণমাধ্যমে বা হাসপাতালে এমন নারীদের পাই, যারা যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার। কিন্তু অধিকাংশ সময় পুলিশ মামলা নিতে চায় না, বিচার হয় না।”
রেজওয়ানার পরিবার এই ঘটনায় দ্রুত বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছে। তাদের ভাষায়, “আমরা শুধু মেয়ে হারাইনি, আমরা বিশ্বাস হারিয়েছি। আমরা চাই যারা এমন বর্বরতা করেছে তাদের কঠোর শাস্তি হোক, এবং যারা আইনি প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছে তাদেরও জবাবদিহি হোক।”
এমন একটি ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি এবং বিচার প্রক্রিয়ার শ্লথতা প্রমাণ করে যে সমাজে এখনো নারী নির্যাতন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং একটি সামগ্রিক সামাজিক ব্যর্থতা। রেজওয়ানার মতো হাজারো নারী আজ বিচার চায়, নিরাপত্তা চায়, আর রাষ্ট্রের কাছে তারা দাবি করে—“আমার মেয়েকে যেন কেউ আর পুড়িয়ে না মারে।”