
ই-ফাইলিং, ডিজিটাল সমন ব্যবস্থাপনা ও বিকল্প ঝামেলাহীন সংশোধনী মডেল প্রতিষ্ঠায় লক্ষমাত্রা
১৪ জুন ২০২৫ তারিখে ঢাকা–বেইলী রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় আইন সহায়তা সংস্থা আয়োজিত “লিগ্যাল এইড ডায়ালগ” অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ঘোষণা করেন, দেশের সিপিসি (নাগরিক বিচারবিধি) সম্পূর্ণ নতুন করে সাজিয়ে তোলা হবে যাতে মামলার নিষ্পত্তি হয় দ্রুত, স্বল্পমূল্যে ও গ্রহণযোগ্য মানসম্পন্ন সিদ্ধান্তে। তিনি বলেন, দীর্ঘ বছর ধরে বিচারব্যবস্থায় সুপ্রিম-কোর্ট থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত বিলম্ব ও অতিরিক্ত খরচের অভিশাপ দমিয়ে রেখেছে সাধারণ মানুষ এবং আইনজীবীদের; সেই অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেতে এ সংশোধনীর বিকল্প নেই।
মে ৬, ২০২৫ সালে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন পায় “সিপিসি (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এ অধ্যাদেশ প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এপ্রিল মাসে অন্তঃসত্ত্বা অনুমোদন শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় ও আইন ও সংসদ বিষয়ক বিভাগে ব্যাপক পরামর্শ-আলোচনার মাধ্যমে। একাধিক পর্যায়ে খসড়া তৈরির পর বিষয়ভিত্তিক স্টেকহোল্ডার—from নতুন ডিজিটাল কোর্টরুম নির্মাণের প্রকৌশলী থেকে আইনজীবি ও এনজিও প্রতিনিধিরা—মন্তব্য প্রদান করেন। চার্চিত সংস্করণে এসব প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সংশোধনী অধ্যাদেশটি বাস্তবায়নের পথে আরও দৃঢ়তা আনে।
সংক্ষেপে, সংশোধনী অধ্যাদেশের মূল ফোকাস হল: সব ধরনের মৌখিক অভিযোগ (ইন-ওপেন কোর্ট প্লাইন্ট) বিলুপ্ত করে সম্পাদকীয়ভাবে লিখিত দায়ের নিশ্চিত করা, যাতে পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো পক্ষের জন্য বারবার শুনানিতে আসা ও বক্তব্য পাঠ করার ঝামেলা না থাকে। একই সঙ্গে সমস্ত আবেদন, পিটিশন ও অর্পিত যুক্তি–তর্ক লিখিত ফরমেটে দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে মামলাপত্রে তথ্যগত অসঙ্গতি ও ভুলের সম্ভাবনা কমবে, বিচারকের পক্ষেও দীর্ঘ কথোপকথন না করেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে।
ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণের অঙ্গীকার হিসাবে, সমন পাঠানোর প্রথা আধুনিকীকরণ করে ই-মেইল, এসএমএস, ভয়েস কল, হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুক মেসেঞ্জার প্রভৃতি মাধ্যমে নোটিশ পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ আনা হয়েছে। এ সেবার মাধ্যমে কাগজপত্রে বিলম্বের কারণে মামলার সমন স্থগিত হওয়ার ঘটনা লাঘব হবে এবং রায় ঘোষণার পর তা দ্রুত পৌঁছে দেবে—যা গ্রামীণ ও দূরবর্তী অঞ্চলসমূহে বিচার সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কার্যকরি ভূমিকা রাখবে।
অর্থসংশ্লিষ্ট ঝামেলার কারণে প্রায়শই মামলায় ইস্ত্রি (adjournment) অনেকবার বাড়ানো যায়। পুরনো বিধি অনুযায়ী litigant বা আইনজীবি সর্বোচ্চ ছয়বার ইস্ত্রি পেত, যা সময়সীমা আরও দীর্ঘায়িত করত। নতুন অধ্যাদেশে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ চারবারে সীমাবদ্ধ করার মতো স্পষ্ট নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিচারককে প্রতিদিনের শুনানির সূচি (cause list) ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়েছে, যাতে মামলার ধরণ—পূর্ণাঙ্গ শুনানি বা আংশিক শুনানি—এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি লিপিবদ্ধ হয়। এর ফলে আদালত কক্ষে সজ্জা, সময় ব্যবস্থাপনা ও পিছিয়ে পড়া মামলার দায়বদ্ধতা বাড়বে।
নাগরিকের চোখে বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে বিকল্প ঝামেলাহীন সংশোধনী (Alternative Dispute Resolution – ADR) মডেল অন্তর্ভুক্তি করা হয়েছে। মীমাংসা (Mediation) ও সালিশি (Arbitration) পদ্ধতি বৈধ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পাবে এবং আইন সহায়তা অফিসারদের মাধ্যমে প্রাপ্য মামলাগুলো ADR-এ পাঠানোর সুযোগ থাকবে। যুক্তরাজ্য, ভারত ও বিশ্বের বেশ কিছু উন্নত বিচারব্যবস্থায় এ ধরনের সমন্বয় কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে; দ্রুত নিষ্পত্তি ও কম খরচ উভয়ই নিশ্চিত হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা দেশীয় প্রেক্ষাপটে প্রয়োগের মাধ্যমে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, ছিটকে পড়া মামলাগুলো নতুনভাবে সুষ্ঠুভাবে সমাধান হতে পারে।
সংস্কারের সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। “দ্য ডেইলি স্টার” পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ই-ফাইলিং প্ল্যাটফর্ম, নিরাপদ ডিজিটাল কোর্টরুম, সার্ভার, ব্যাকআপ সিস্টেম ও আইনকর্মীদের প্রশিক্ষণ ছাড়া সিপিসি সংশোধনী কেবল আদর্শাবাদে আটকে যাবে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদালতে বিদ্যমান আইসিটি সুবিধার অভাবে নতুন নিয়ম বাস্তবায়নে দেরি হলে নাগরিকের আস্থার অপচয় ঘটতে পারে। তাই সংশোধনী কার্যকর করার আগে অবকাঠামোগত ও মানবসম্পদ প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হবে বলে আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
আইন ও ন্যায় বিভাগ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সংশোধনী অধ্যাদেশ কয়েক দিনের মধ্যে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হবে। এর পর অনলাইনে “ওপেন পরামর্শ” সংস্করণ প্রকাশ করে সর্বসাধারণের মতামত আহ্বান জানানো হবে, যেখানে ৩ মার্চ, ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত মন্তব্য জানাতে পারবেন সংশ্লিষ্ট পক্ষ। পরামর্শ গ্রহণের পর চূড়ান্ত নিয়মাবলী নির্ধারণের মাধ্যমে সংশোধনী কার্যকর হবে। এ ধাপে পাবলিক অংশগ্রহণ বাড়ানো আইন বিভাগ এবং সুপ্রিম-কোর্টের যৌথ উদ্যোগ—যার ফলে মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে প্রস্তাবগুলোর মান আরও উন্নত হবে।
সর্বোপরি, সিপিসি (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৫ গ্রাহ্য হলে বাংলাদেশে নাগরিক বিচারব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে: মামলার নিষ্পত্তি হবে দ্রুত, খরচ কমে অনুভূতিশীল ফলাফল নিশ্চিত হবে, আদালতের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়বে এবং আইনী মতলব-দস্তাবেজের জটিলতা দূর হবে। দীর্ঘ লাইন ছোঁড়া, কাগজপত্রে বিলম্ব বা প্রবেশ বাধা কেটে গেলে দেশের প্রত্যেক নাগরিক বসে বা অনলাইনে সহজেই বিচার সেবা পাবে। এ নতুন অধ্যাদেশ বাংলাদেশের আইনী ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন, কারণ সিপিসি সংশোধনী দেশকে আধুনিক, দক্ষ ও মানবমুখী বিচার ব্যবস্থায় পা রাখতে সহায়তা করবে।