২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য রক্ষণশীল বাজেট: সংকোচন নাকি স্থিতিশীলতা?

স্বল্প ব্যয়ের বাজেটের পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট, বিনিয়োগে স্থবিরতা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় কাটছাঁট এবং রাজস্ব আহরণে বাস্তবতাবোধ প্রশ্নবিদ্ধ

বাংলাদেশ সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করেছে, সেটিকে অর্থনীতিবিদরা রক্ষণশীল এবং সংকোচনমূলক হিসেবে বর্ণনা করছেন। বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.৯ লাখ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এমন সংকোচনের পেছনে রয়েছে বহুমাত্রিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপে দেশীয় অর্থনীতির দুর্বলতা, এবং রাজস্ব আদায়ের ব্যর্থতা।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট

২০২৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি অস্থায়ী সরকার গঠন হলেও রাজনৈতিক উত্তেজনা পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি। সরকার পক্ষ একদিকে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন, অবরোধ, এবং বৈদেশিক চাপে রাজনৈতিক পরিবেশ এখনও উত্তপ্ত। এর পাশাপাশি রয়েছে বৈশ্বিক বাজারে মূল্যস্ফীতির ধাক্কা এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে চাপ, যা বাজেট প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।

গত ২৭ মাস ধরে বাংলাদেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে ছিল, যা মে ২০২৫-এ নেমে এসেছে ৯.০৫ শতাংশে। এটি সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু নীতিগত পদক্ষেপের সুফল হলেও এখনও তা নাগরিকদের জীবনযাত্রার ব্যয়ে বড় ধরনের স্বস্তি দিতে পারেনি।

রাজস্ব আয় ও করনীতির বাস্তবতা

বাজেটে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫.৬৪ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে ৫ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে পূর্ববর্তী বছরের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, এই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বাস্তবভিত্তিক প্রশ্ন উঠেছে।

বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনো ৮ শতাংশের নিচে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। সরাসরি কর আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে বাজেটে আবারো পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা দেখানো হয়েছে, যা দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর অর্থনৈতিক চাপ আরও বাড়াবে।

২০২৬-২৭ অর্থবছর থেকে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩.৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩.৭৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব থাকলেও এটি বাস্তবায়নের আগে মধ্যবিত্তের স্বস্তি আসবে না।

স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি খাতে বরাদ্দ কমেছে

স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ (ADP) কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে ২,৫৩৫ কোটি টাকা ও ২,৯৭১ কোটি টাকা। এই খাতগুলো দেশের মানব উন্নয়ন সূচকে সরাসরি প্রভাব ফেলে। অথচ এই দুটি খাতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ প্রয়োজন ছিল কোভিড-পরবর্তী স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা বিস্তারে।

কৃষি খাতেও বরাদ্দ কমেছে ২,৪২৪ কোটি টাকা, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। খাদ্য উৎপাদন ও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে হলে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল।

ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ও শৃঙ্খলা

ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম, খেলাপি ঋণ ও সুশাসনের অভাব দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনীতির অন্যতম দুর্বল দিক। এ সমস্যা মোকাবেলায় সরকার ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫’ নামে একটি নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এই আইন ব্যাংকসমূহের দেউলিয়াত্ব নিরসন, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে।

এটি বাস্তবায়িত হলে ব্যাংকিং খাতের ওপর জনগণের আস্থা ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে শুধু আইন নয়, প্রয়োগ এবং নিয়ন্ত্রণমূলক কঠোরতা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশ

বাজেটে কিছু পণ্যের উপর সম্পূরক শুল্ক ও কাস্টমস ডিউটি হ্রাসের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যবসার খরচ কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু উচ্চ সুদের হার, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দুর্বল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগকারীরা এখনো নিরাপদ বোধ করছেন না।

বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন, সেটির অভাব স্পষ্ট।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পুনর্গঠন

প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সংখ্যা ১৪০ থেকে কমিয়ে ৯৫-এ আনা হয়েছে। এটি বাজেট ব্যয় দক্ষ করার জন্য ভালো উদ্যোগ হলেও অনেক প্রকৃত দরিদ্র জনগণ বাদ পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে এসব সুবিধা বণ্টনের ব্যবস্থা না থাকলে এই খাতে বরাদ্দ কমানোর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা ও বাস্তবতা

২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার আশা করা হয়েছে। কিন্তু এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে সরকারকে রাজস্ব প্রশাসনে কাঠামোগত সংস্কার, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, এবং উৎপাদন খাতে দক্ষতা বাড়াতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর পুনর্গঠনের উদ্যোগ শুরু হলেও কর্মকর্তাদের প্রতিরোধের কারণে তা থমকে গেছে। এই সংস্কার ছাড়া রাজস্ব আহরণে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি আসবে না।


২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট একটি বাস্তবতানির্ভর ও রক্ষণশীল প্রচেষ্টা। সংকটময় সময়ে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং রাজস্ব আহরণের দিকে মনোযোগ ভালো দিক, তবে দীর্ঘমেয়াদী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও মানব উন্নয়ন সূচকে অগ্রগতি পেতে হলে সাহসী সংস্কার ও কার্যকর বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

Related Posts

Leaked Audio Reveals Sheikh Hasina Ordered Deadly Crackdown on 2024 Bangladesh Protesters

Leaked audio reveals Sheikh Hasina ordered lethal force on 2024 Bangladesh protesters; UN confirms over 1,400 killed in deadly crackdown.

Bangladesh’s Economy Grew 50% in 8 Years, But Job Creation Lagged Behind

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You Missed

Leaked Audio Reveals Sheikh Hasina Ordered Deadly Crackdown on 2024 Bangladesh Protesters

  • By Chris
  • August 4, 2025
  • 101 views
Leaked Audio Reveals Sheikh Hasina Ordered Deadly Crackdown on 2024 Bangladesh Protesters

Bangladesh’s Economy Grew 50% in 8 Years, But Job Creation Lagged Behind

  • By Chris
  • July 23, 2025
  • 130 views
Bangladesh’s Economy Grew 50% in 8 Years, But Job Creation Lagged Behind

Bangladesh Urgently Seeks U.S. Trade Talks to Avoid 35% Tariff on Garment Exports

  • By Chris
  • July 23, 2025
  • 137 views
Bangladesh Urgently Seeks U.S. Trade Talks to Avoid 35% Tariff on Garment Exports

Death Toll Rises to 31 in Bangladesh Air Force Jet Crash at Dhaka School

  • By Chris
  • July 22, 2025
  • 121 views
Death Toll Rises to 31 in Bangladesh Air Force Jet Crash at Dhaka School

Bangladesh Air Force Jet Crash Kills 27, Including 25 Children, at Dhaka School

  • By Chris
  • July 22, 2025
  • 145 views
Bangladesh Air Force Jet Crash Kills 27, Including 25 Children, at Dhaka School

Chief Justice Appoints 2 Justices — Justice Rezaul Haque and Justice Farah Mahbub — as Chamber Judges of Supreme Court

  • By Chris
  • July 21, 2025
  • 128 views
Chief Justice Appoints 2 Justices — Justice Rezaul Haque and Justice Farah Mahbub — as Chamber Judges of Supreme Court