
আসাম ও অরুণাচল প্রদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি; গৌহাটিতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন, স্কুল-কলেজ বন্ধ
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের ফলে অন্তত ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও সংবাদমাধ্যম। গত কয়েক দিনের টানা ভারী বর্ষণে আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও মনিপুর রাজ্যে ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক এলাকা এখনও পানির নিচে, বন্ধ রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

দুর্যোগের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ আসামে
আসাম রাজ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে রাজ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (ASDMA)। রাজধানী গৌহাটি সহ বেশ কয়েকটি শহরে টানা বৃষ্টিতে রাস্তা-ঘাট ও বাসাবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। রাজ্য সরকার মঙ্গলবার (১ জুন) পর্যন্ত রাজ্যের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে।
ASDMA জানায়, শুধু আসামেই গত ২৪ ঘণ্টায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন শিশু ও দুজন নারী রয়েছেন, যাদের মৃত্যু হয়েছে ঘর ধসে পড়ে ও পানিতে ডুবে। আরও বহু মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী ও জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী (NDRF) উদ্ধার কার্যক্রমে নিযুক্ত রয়েছে।
অরুণাচল প্রদেশেও প্রাণহানির ঘটনা
অরুণাচল প্রদেশের পূর্ব কামেং জেলায় একটি মাইক্রোবাস ভূমিধসে গিরিখাতে পড়ে গেলে সাতজন নিহত হন। দুর্ঘটনাটি ঘটে রবিবার রাতে। একইসাথে নিম্ন সুবানসিরি জেলায় একটি খামারে ভূমিধসের কারণে দুইজন মারা যান।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু এক বিবৃতিতে বলেন, “এই দুর্যোগ আমাদের গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। সরকার উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে।”
মেঘালয় ও মিজোরামে পরিস্থিতি অবনতি
ভারতের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি ও মৌসিনরামে একদিনে ৪৭ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। অতিবৃষ্টির ফলে একাধিক ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। বজ্রপাত ও বন্যায় রাজ্যে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পাহাড়ি অঞ্চলে।
মিজোরামের রাজধানী আইজল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে একটি হোটেল ধসে পড়ে ছয়জন মারা যান, যাদের মধ্যে তিনজন বিদেশি (মিয়ানমারের নাগরিক) ছিলেন। ঘটনাটি স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। প্রশাসন জানিয়েছে, অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে হোটেলের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
অন্যান্য রাজ্যের পরিস্থিতি
নাগাল্যান্ডের কোহিমা জেলায় ভূমিধসে একজন নিহত হন এবং একাধিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মনিপুরে নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বহু মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে।
আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস
ভারতের আবহাওয়া দফতর (IMD) জানিয়েছে, বাংলাদেশ ও মেঘালয় অঞ্চলের উপর একটি সক্রিয় নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে, যার কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
IMD এর এক কর্মকর্তা জানান, “মৌসুমি বৃষ্টিপাতের প্রকোপ এবার কিছুটা বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।”
সরকার ও ত্রাণ কার্যক্রম
আসাম, অরুণাচল, মেঘালয় এবং অন্যান্য রাজ্য সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম জোরদার করেছে। জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (NDMA), সেনাবাহিনী ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে কাজ করছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, “আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জরুরি সহায়তা পৌঁছে দিতে সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জনগণকে অনুরোধ করছি নিরাপদ স্থানে অবস্থান করতে এবং প্রশাসনের নির্দেশনা অনুসরণ করতে।”
অতীতের পুনরাবৃত্তি?
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল প্রায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ভূমিধস ও বন্যার মুখোমুখি হয়। তবে এবারের দুর্যোগের মাত্রা কিছুটা বেশি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জলবায়ু পরিবর্তন, অনিয়ন্ত্রিত পাহাড়ি খনন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণকে দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা।
উপসংহার
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চলমান এই দুর্যোগ আবারও স্মরণ করিয়ে দিল, কিভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। বন্যা ও ভূমিধস কেবল অবকাঠামোগত ক্ষতির কারণ নয়, এটি মানবিক সংকটও তৈরি করে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শুধু ত্রাণ নয়, দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কৌশল।