
ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য—বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে হবে অবিলম্বে নির্বাচন।
বাংলাদেশে ভারতের ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের’ আহ্বান: এক বিস্তৃত প্রতিবেদন
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে ভারত একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—এই উপমহাদেশের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন’ জরুরি। ঢাকায় সরকারি চাকরিজীবী ও ছাত্র সংগঠনগুলোর আন্দোলনের মধ্যেই ভারতের এই বক্তব্য কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, “বাংলাদেশে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। আমরা চাই বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও ইতিবাচক, গঠনমূলক এবং দুই দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে গড়ে উঠুক।”
চলমান অস্থিরতা ও অন্তর্বর্তী সরকার
এই বিবৃতি এমন সময় এসেছে যখন বাংলাদেশে ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সেই থেকে নির্বাচন পিছিয়ে যেতে থাকে এবং প্রশাসনিক কাঠামোতে সংকট প্রকট হতে থাকে।
বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষক এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন নির্বাচন আয়োজন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফেরানোর দাবিতে বিক্ষোভ করছে। এরই মধ্যে অনেকেই অভিযোগ করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থ এবং জনগণের সাথে দূরত্ব বাড়ছে।
ভারতকে দোষারোপ ও জবাব
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান মুহাম্মদ ইউনুস এক বিবৃতিতে ঢাকার অস্থিরতার জন্য ভারতকে দায়ী করেন বলে কিছু সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে। তবে ভারতের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়।
রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “আমরা মনে করি, এ ধরনের বক্তব্য দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো থেকে মনোযোগ সরানোর কৌশলমাত্র। বাংলাদেশ তার গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনঃস্থাপন করবে এবং তা একান্তভাবে তাদের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া।”
আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতের স্বার্থ
ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি কেবল কূটনৈতিক সৌজন্য নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার সঙ্গেও সরাসরি সম্পর্কিত। বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সংকট এবং প্রশাসনিক ভঙ্গুরতা ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতেও প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামে এই প্রভাব প্রত্যক্ষ হয়।
ভারত চায় বাংলাদেশে এমন একটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবেশ বিরাজ করুক, যেখানে গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন পাশাপাশি এগিয়ে যাবে। ভারতের এই নীতিগত অবস্থান কেবল প্রতিবেশী সম্পর্ক নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের নেতৃত্বের দাবিকেও শক্তিশালী করে।
জনগণের অভিমত ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখন রাজনীতির বাইরে গিয়ে স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছ প্রশাসন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সুশাসন চায়। ছাত্র আন্দোলন, শিক্ষক বিক্ষোভ এবং সাংবাদিক সমাজের প্রতিবাদ এটাই প্রমাণ করে যে, মানুষ আর রাজনৈতিক শূন্যতায় থাকতে চায় না। তারা বাস্তবসম্মত সমাধান চায়, এবং সেই সমাধান আসতে পারে একটি বিশ্বাসযোগ্য, অবাধ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে।
এক্ষেত্রে ভারতের বক্তব্য একটি সময়োপযোগী আন্তর্জাতিক বার্তা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এটি হতে পারে একটি আত্মসমালোচনার সুযোগ—যেখানে জনগণের কথা, শিক্ষার পরিবেশ, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক সব কিছুকে বিবেচনায় নিতে হবে।
উপসংহার
ভারতের এই ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের’ বার্তা কোনো হস্তক্ষেপ নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত ও মানবিক আহ্বান—যাতে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা যায় এবং দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশ কিভাবে এই বার্তার প্রতি সাড়া দেয় এবং কীভাবে আগামি দিনগুলোতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিণত হয়।