ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ: জাপানের নিক্কেই ফোরামে নির্বাচনের প্রস্তুতি ও এশিয়ার ভবিষ্যত

নির্বাচনের প্রস্তুতিতে সচেষ্ট সরকার: ড. মুহাম্মদ ইউনূস

 

বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারিকভাবে চলছে নির্বাচনী প্রস্তুতি। দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার, ২৮ মে ২০২৫ তারিখে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক নাগরিক সংলাপে বলেন, “২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।”

চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে এই বক্তব্য বিশাল তাৎপর্য বহন করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি সরকারের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, যা জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হতে পারে।

সময়সীমা নির্ধারণ ও পরিকল্পনা
চট্টগ্রামে আয়োজিত ওই নাগরিক সংলাপে ড. ইউনূস বলেন, “আমরা একটি স্বচ্ছ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই, এবং তার প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু হয়েছে।” তিনি আরও জানান, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সমন্বয় করে সম্ভাব্য সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের আয়োজন সম্ভব হয়।

তিনি বলেন, “নির্বাচনের তারিখ এখনই ঘোষণা করছি না, কারণ প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যালোচনা সাপেক্ষে আমরা সময়সূচি ঘোষণা করবো। তবে আমাদের লক্ষ্য স্পষ্ট—২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই নির্বাচন শেষ করতে চাই।”

প্রশাসনিক প্রস্তুতি ও নির্বাচনী সংস্কার
ড. ইউনূস তার বক্তব্যে প্রশাসনিক উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “ভোটার তালিকা হালনাগাদ, কেন্দ্র পুনর্বিন্যাস এবং নতুন ভোটার নিবন্ধনের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।” নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের স্বাধীনতা ও সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে।

তিনি আরও জানান, “ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (EVM) ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। তবে প্রযুক্তির পাশাপাশি মানুষের আস্থা অর্জনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

নির্বাচনী আচরণবিধি হালনাগাদ এবং নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে সরকার বেশ কিছু আইনি সংস্কার নিয়েও কাজ করছে।

রাজনৈতিক সংলাপ ও সর্বদলীয় অংশগ্রহণ
একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের অন্যতম শর্ত সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ। ড. ইউনূস বলেন, “নির্বাচন কোনো একক দলের বা সরকারের বিষয় নয়। এজন্য আমরা চাই সব রাজনৈতিক দল আলোচনায় বসুক এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।”

সরকার ইতোমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে। সংলাপের মাধ্যমে দলগুলোর মতামত সংগ্রহ করে নির্বাচন কমিশনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হচ্ছে। এমনকি যারা অতীতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল, তাদের সঙ্গেও কথা বলার প্রক্রিয়া চলছে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও গ্রহণযোগ্যতা
ড. ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশের নির্বাচন যেন আন্তর্জাতিক পরিসরে গ্রহণযোগ্য হয়, সেজন্য আমরা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানাতে প্রস্তুত।” তিনি জানান, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা চলছে।

তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই, এই নির্বাচন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হোক। এতে করে দেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি আরও দৃঢ় হবে।”

তরুণ ভোটার ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা
চলমান প্রক্রিয়ায় তরুণদের যুক্ত করার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, “তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করে তুলতে আমরা বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছি। ভোটার রেজিস্ট্রেশন, ডিজিটাল সচেতনতা এবং অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি চালু করা হয়েছে।”

সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম এবং স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন সভা-সমাবেশের মাধ্যমে নাগরিক সমাজকে সচেতন ও সক্রিয় করে তুলতে চাইছে।

আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
নির্বাচনের সময় যে কোনো ধরনের সহিংসতা বা বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে সরকার বিশেষ নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ড. ইউনূস জানান, “পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসার বাহিনীকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। নির্বাচনী পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল কাজ করছে।”

তিনি বলেন, “নির্বাচন যেন কোনোভাবেই সহিংসতায় রূপ না নেয়, সেটিই আমাদের মূল লক্ষ্য। জনগণ যেন নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে, তা নিশ্চিত করাই সবচেয়ে জরুরি।”

সময়সূচি ঘোষণা আসছে শিগগিরই
যদিও এখনো নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত তারিখ ঘোষণা করেনি, তবে ড. ইউনূস জানিয়েছেন, “যথাসময়ে নির্বাচন কমিশন সময়সূচি ঘোষণা করবে। আমরা সব প্রস্তুতি নিচ্ছি এবং প্রত্যাশা করছি, নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক উৎসবে পরিণত হবে।”

উপসংহার
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এ ধরনের দৃঢ় অবস্থান দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। চট্টগ্রামে দেওয়া এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে সরকার শুধু নির্বাচন আয়োজনেই নয়, বরং অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণেও সচেষ্ট।

একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য, নাগরিক সচেতনতা এবং প্রশাসনিক নিষ্ঠা। যদি সব পক্ষ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, তবে আগামী নির্বাচন হতে পারে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি নতুন দিগন্তের সূচনা।

  • Related Posts

    Japan Commits Over $1 Billion to Bangladesh for Economic Reforms and Infrastructure Development

    বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ডাক ভারতের: আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে দিল্লির কূটনৈতিক বার্তা

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You Missed

    Japan Commits Over $1 Billion to Bangladesh for Economic Reforms and Infrastructure Development

    • By Chris
    • May 30, 2025
    • 32 views
    Japan Commits Over $1 Billion to Bangladesh for Economic Reforms and Infrastructure Development

    বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ডাক ভারতের: আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে দিল্লির কূটনৈতিক বার্তা

    • By Chris
    • May 30, 2025
    • 15 views
    বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ডাক ভারতের: আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে দিল্লির কূটনৈতিক বার্তা

    Bangladesh’s Universities in Turmoil: Politicization, Protest, and a Stalled Future

    • By Chris
    • May 30, 2025
    • 10 views
    Bangladesh’s Universities in Turmoil: Politicization, Protest, and a Stalled Future

    Rooppur, MRT-1, and Matarbari Projects Get Major Boost in Bangladesh Budget 2025-26

    • By Chris
    • May 29, 2025
    • 27 views
    Rooppur, MRT-1, and Matarbari Projects Get Major Boost in Bangladesh Budget 2025-26

    ইউরোপ সেরার হ্যাটট্রিক পূরণ করলো চেলসি: কনফারেন্স লিগ জয়ে ইতিহাস

    • By Chris
    • May 29, 2025
    • 20 views
    ইউরোপ সেরার হ্যাটট্রিক পূরণ করলো চেলসি: কনফারেন্স লিগ জয়ে ইতিহাস

    ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ: জাপানের নিক্কেই ফোরামে নির্বাচনের প্রস্তুতি ও এশিয়ার ভবিষ্যত

    • By Chris
    • May 29, 2025
    • 32 views
    ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ: জাপানের নিক্কেই ফোরামে নির্বাচনের প্রস্তুতি ও এশিয়ার ভবিষ্যত