
জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞানীদের নতুন আশঙ্কা, সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে উন্নয়নশীল ও উপকূলীয় দেশসমূহ
ঢাকা, ২৮ মে ২০২৫:
জাতিসংঘের অধীনস্থ বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO) সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৫ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে যেকোনো একটি বছরে বৈশ্বিক গড় উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমা অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে ৭০ শতাংশ। এই সতর্কতা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের এক ভয়াবহ বাস্তবতার দিক নির্দেশ করে যা মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য উৎপাদনে বিঘ্ন এবং ব্যাপক পরিবেশগত সংকট দেখা দিতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল ও উপকূলবর্তী দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ, যেটি ইতোমধ্যেই এ সংকটের সম্মুখীন।
🔥 ইতিহাসের সর্বোচ্চ উষ্ণতা ২০২৪ সালে
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সাল ছিল মানব ইতিহাসে রেকর্ডকৃত সবচেয়ে উষ্ণ বছর। সেই বছর বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের গড় তাপমাত্রার তুলনায় ১.৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এল নিনো আবহাওয়া প্যাটার্ন, বাড়তি কার্বন নিঃসরণ, বন উজাড়, এবং জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার।
আবহাওয়াবিদদের মতে, এল নিনোর প্রভাব অস্থায়ী হলেও, এটি বর্তমানে চলমান মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে। ফলে, বৈশ্বিক উষ্ণতা দ্রুত সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে যা উদ্বেগজনক।
🌊 বাংলাদেশ ও উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর জন্য ভয়াবহ বার্তা
বাংলাদেশ, একটি জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে, এই প্রতিবেদনকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন এবং লবণাক্ততার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমা ছাড়িয়ে গেলে এই দুর্যোগগুলো আরও ঘন ঘন এবং ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীমা হোসেন বলেন,
“১.৫ ডিগ্রি সীমা হলো একটি সতর্কসীমা। এটি অতিক্রম করলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “খাদ্য নিরাপত্তা, পানি সংকট, স্বাস্থ্য সমস্যা এবং অভ্যন্তরীণ জলবায়ু উদ্বাস্তু সংকট ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।”
🧪 ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমার অর্থ কী?
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে পৃথিবীতে চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। এটি কেবল আবহাওয়া বা জলবায়ুর পরিবর্তন নয়, বরং এটি মানব সভ্যতার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত স্থিতিশীলতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষ করে:
-
বরফঢাকা অঞ্চলগুলো দ্রুত গলে যাবে।
-
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অস্বাভাবিকভাবে বাড়বে।
-
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তীব্র খরা এবং বন্যা দেখা দেবে।
-
চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমবে এবং খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে।
-
কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।
❗ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এই প্রতিবেদন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন,
“এটি একটি রেড অ্যালার্ট। যদি আমরা এখনই কার্বন নিঃসরণ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ না নিই, তাহলে আমরা মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।”
ব্রিটেনের মেট অফিস এবং ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম-রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যতের দূরবর্তী হুমকি নয়, এটি বর্তমান বাস্তবতা।
📊 পরিসংখ্যান যা চিন্তার কারণ
জাতিসংঘের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে:
-
২০১১–২০২০: গড় উষ্ণতা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।
-
২০২৪: গড় তাপমাত্রা ১.৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে।
-
২০২৫-২০২৯: এই পাঁচ বছরের মধ্যে যেকোনো বছরে ১.৫ ডিগ্রি সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৭০%।
এই তথ্যগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে চলমান প্রচেষ্টার ব্যর্থতাকেই তুলে ধরে।
🛑 প্যারিস চুক্তির ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে
২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তির প্রধান লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রির নিচে এবং সম্ভব হলে ১.৫ ডিগ্রির নিচে রাখা। কিন্তু জাতিসংঘের এই পূর্বাভাস স্পষ্টভাবে জানাচ্ছে, এই লক্ষ্যমাত্রা রক্ষা করা এখন অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বহু দেশ প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে কার্বন নিঃসরণ কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। উন্নত দেশগুলো বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়নি।
✅ করণীয়
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এখনো সময় আছে যদি বিশ্ব একযোগে কিছু পদক্ষেপ নেয়:
-
জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা হ্রাস করা
-
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি
-
বন উজাড় রোধ
-
পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ
-
উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অভিযোজন ফান্ড সরবরাহ
বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ানো, উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার এবং জলবায়ু শিক্ষার প্রসার।
🔚 উপসংহার
জাতিসংঘের নতুন এই প্রতিবেদন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে— জলবায়ু সংকট ভবিষ্যতের নয়, এটি আজকের বাস্তবতা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের জন্য এটি একটি জরুরি আহ্বান। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে চরম মূল্য দিতে হবে