
২০১৪ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জামিন আদেশে গাজীপুর কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে বিষয়টি ঘিরে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া।
ঢাকা, ২৮ মে ২০২৫:
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জামিন আদেশে আজ বিকালে গাজীপুর কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আদালতের আদেশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
আদালতের আদেশে বলা হয়েছে, মানবিক বিবেচনায় এবং তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে। জামিনের শর্তানুযায়ী তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না এবং আদালতের পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত নিজ বাসায় অবস্থান করবেন।
আজহারুল ইসলামের আইনজীবী ব্যারিস্টার শাহ আব্দুল কাইয়ুম গণমাধ্যমকে জানান, “আমরা আদালতে তার চিকিৎসাজনিত কারণে জামিনের আবেদন করেছিলাম। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং চোখের সমস্যায় ভুগছেন। আদালত বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখে জামিন দিয়েছেন।”
এ টি এম আজহারুল ইসলাম ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন। রংপুরে সংঘটিত গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতনসহ মোট ৬টি অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়, যার মধ্যে ৫টিতেই দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। পরে তিনি রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন, যা বর্তমানে বিচারাধীন।
কারাগার থেকে মুক্তির সময় তার পরিবারের সদস্য এবং দলীয় নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। ছেলেসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা জানান, কারাগারে তার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল এবং তারা চরম উদ্বেগে ছিলেন।
এই জামিন আদেশকে ঘিরে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আজহারুল ইসলামের জামিনে মুক্তি ন্যায়বিচারের বিজয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফলে তিনি দীর্ঘদিন কারাবন্দি ছিলেন।”
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংগঠন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে এর বিরোধিতা করা হয়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এক বিবৃতিতে জানায়, “মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত একজন অপরাধীর জামিন দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করে।”
বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি না দিলেও, ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে যে দলের শীর্ষ পর্যায়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। একটি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “এ ধরনের সিদ্ধান্তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।”
আজহারুল ইসলামের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মুক্তির পর তিনি চিকিৎসার জন্য রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হবেন। পরিবারের সদস্যরা আশা করছেন, উন্নত চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
কারা কর্তৃপক্ষের বরাতে জানা যায়, কারাগারে থাকাকালে আজহারুল ইসলাম অন্তত ১২ বার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। তার ইনসুলিন-নির্ভর ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা এবং চোখের অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। এসব কারণেই জামিনের আবেদন দাখিল করা হয়।
এই ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নজরে এসেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, “আদালতের সিদ্ধান্তকে আমরা নজরে রাখছি। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া যেন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ টি এম আজহারুল ইসলামের জামিন দেশের বিচারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে। একজন মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তির জামিন সাধারণত বিরল ঘটনা। এতে করে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে তারা মনে করেন।
তবে তার আইনজীবীরা একে নিছক আইনি বিষয় বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তারা বলেন, “আদালত নিজ বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়।”
এদিকে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো তার মুক্তিকে ‘বিচারের সাফল্য’ হিসেবে তুলে ধরছে। একটি অনানুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা জানান, “এই মুক্তি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রমাণ।”
সার্বিকভাবে, আজহারুল ইসলামের মুক্তির ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট এবং আইনি প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। মানবিক কারণে জামিন দেওয়া হলেও এর প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।