
আন্দোলনের পরে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে নির্দিষ্ট সময়সূচিভিত্তিক নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবি বিএনপি ও গণসংহতি আন্দোলনের
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উত্তেজনা প্রশমনের জন্য একটি সময়সীমাবদ্ধ, নির্দিষ্ট ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং অন্যান্য সমমনা দলগুলোর মতে, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনের নিশ্চয়তা ছাড়া রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরবে না। বিরোধী দলের আন্দোলনের পর সরকার এবং বিরোধী পক্ষের মধ্যে যে বিভক্তি এবং উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা নিরসনের একমাত্র পথ হতে পারে একটি সম্মিলিত রাজনৈতিক রূপরেখা।
গত কয়েক মাসে দেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন তারা মেনে নেবে না। তারা দাবি করেছে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের। এই দাবি নিয়ে তারা আন্দোলনে নেমেছে এবং এতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ, অবরোধ ও রাজনৈতিক সহিংসতা লক্ষ্য করা গেছে। সরকার যদিও সংলাপের কথা বলেছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা বা সময়সূচি ঘোষণা করেনি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার বলেছেন, “আলোচনার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু আলোচনায় ফল আসবে তখনই যখন সরকার একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। শুধু সংলাপ করে সময়ক্ষেপণ করে গেলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান সংকটের মূল কারণ হলো জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক আস্থাহীনতা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না। তাদের মতে, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন এবং নিরাপত্তা বাহিনী সবই সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাই তারা একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছে।
সরকারের পক্ষ থেকে যদিও বলা হচ্ছে যে তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর, তবে বিরোধী দলগুলো বলছে, কথার কোনো ভিত্তি নেই যদি তা বাস্তব রূপ না পায়। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। বিগত নির্বাচনে যেসব অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছিল, সেগুলোর কোনো সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। এই পরিস্থিতিতে একটি গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপ না থাকলে দেশে সহিংসতা আরও বাড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।
গণসংহতি আন্দোলন, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্যসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলোও একই সুরে কথা বলছে। তাদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বলছে, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে সাধারণ জনগণও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ক্ষুব্ধ। বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের অভাব, দুর্নীতি, সেবা খাতে ব্যর্থতা এসব সমস্যার কারণে জনগণ ইতোমধ্যেই চাপে রয়েছে। তার উপর যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা যোগ হয়, তাহলে জনগণের জীবনযাত্রা আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। তারা চায় শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়া, যেখানে সকল দলের অংশগ্রহণ থাকবে এবং যার ফলাফল জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড। যদি সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকে, তাহলে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রই অকার্যকর হয়ে পড়ে। আর যখন বিরোধী দলের আন্দোলন এবং সরকারের কঠোর অবস্থান একত্রিত হয়, তখন একটি সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সেই ধরনের এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।
এই প্রেক্ষাপটে সময়মতো একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা শুধু রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নয়, বরং এটি জনগণের আস্থার প্রতীক হিসেবে কাজ করবে। এতে করে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন প্রশমিত হতে পারে এবং সংলাপের মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
রোডম্যাপ মানে শুধুমাত্র নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নয়। এর মধ্যে থাকতে হবে নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার নিরাপত্তা এবং ফলাফল প্রকাশে স্বচ্ছতা। এই বিষয়গুলো স্পষ্ট করে জানানো না হলে রোডম্যাপের কোনো মূল্য থাকবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা মনে করে, এই মুহূর্তে সবার আগে দরকার একটি সর্বসম্মত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা হবে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন।
এই সংকট থেকে উত্তরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠন এবং সব দলের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন। এজন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা, দৃঢ়তা এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে যে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা নিরসনে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হতে পারে একটি গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপ। এই রোডম্যাপ শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নয়, বরং দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য প্রয়োজন। কারণ, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা পেলে জনগণের ভোগান্তি কমবে, নীতি নির্ধারণে স্বচ্ছতা আসবে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব হবে