

রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশ নির্বাচন ২০২৫-এর আগে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও প্রশাসনিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
ঢাকা, ২৩ মে ২০২৫ – বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এই ঘোষণাকে ঘিরে বিরোধী দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারী দলগুলো নানা প্রশ্ন তুলেছে। এ বিষয়ে সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী রিজওয়ানা হাসান মন্তব্য করেছেন যে, “নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় জানিয়ে সরকার নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে ভাবলেও প্রকৃতপক্ষে তারা এখনো নানা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।”
তিনি বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে একটি বেসরকারি সেমিনারে বলেন, “নির্বাচনের সময় ঘোষণাটি কৌশলগত, কিন্তু এটি কোনো সমাধান নয়। জনগণ এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে এই সরকার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে পারবে।”
প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ
রিজওয়ানা হাসান অভিযোগ করেন, সরকার এখনো প্রশাসন, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিচার ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, “যে নির্বাচনের আগে প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেখানে সুষ্ঠু ভোট আশা করা যায় না। আমরা দেখছি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমন করতে পুলিশ ও র্যাব ব্যবহার করা হচ্ছে, যেটা একেবারেই অগণতান্ত্রিক।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমান সরকারের অধীনে আগের নির্বাচনগুলোতে যেভাবে অনিয়ম হয়েছে, এবারেও তার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা এমন একটি পরিবেশ দেখতে পাচ্ছি যেখানে প্রশাসনিক ভারসাম্য নেই, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে বাধা, এবং ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা নেই।”
নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ
বর্তমান নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে রিজওয়ানা বলেন, “একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ছাড়া কখনোই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। বর্তমান কমিশন এখনো সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে আছে। নির্বাচন কমিশনের প্রধান কারো কথায় কিছু করতে পারছেন না—এটা জনগণ উপলব্ধি করছে।”
তিনি বলেন, “নির্বাচনের দিন ভোট পড়ার আগেই যদি নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে সেই নির্বাচনের ফলাফল কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে?”
বিরোধী দলের দমন ও ভয়ের পরিবেশ
রিজওয়ানা হাসান বলেন, “আজকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে পারছে না। যারা জনগণের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে, তাদের পরিবারকেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এসব কিছু করে সরকার একটি ‘ভয়ের পরিবেশ’ তৈরি করেছে যাতে সাধারণ মানুষও রাজনীতিতে অংশ নিতে না চায়।”
তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও দমন-পীড়ন কোনো সরকারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সফলতা বয়ে আনে না। বরং এর ফলে জনগণের মাঝে অসন্তোষ বাড়ে, এবং এক সময় তা বড় আন্দোলনের রূপ নিতে পারে।”
সংলাপের প্রয়োজনীয়তা
রিজওয়ানা হাসান মনে করেন, রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে সংলাপ দরকার। তিনি বলেন, “সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যদি কোনো আলোচনার ভিত্তি না থাকে, তাহলে নির্বাচন কখনোই শান্তিপূর্ণ হবে না। সংলাপই একমাত্র পথ যার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা সম্ভব।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই সরকার আন্তরিকভাবে সংলাপে বসুক। যে জাতি দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় আছে, সেখানে আর কোনো একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। বরং সময় এসেছে, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।”
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের গুরুত্ব
রিজওয়ানা হাসান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকাও গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনে অংশ নিলে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ বাড়ে সঠিকভাবে কাজ করার জন্য। আমরা চাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, এবং অন্যান্য দেশসমূহ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকুক।”
তিনি আরও বলেন, “এই দেশের জনগণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কী বার্তা যায় তা নিয়েও সচেতন। যদি নির্বাচন সঠিকভাবে না হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক মহলেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।”
নাগরিক সমাজ ও তরুণদের ভূমিকা
এছাড়া তিনি নাগরিক সমাজ ও তরুণদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। “নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয় নয়। এটি একটি জাতীয় দায়িত্ব। তরুণরা যদি রাজনীতিতে আগ্রহী না হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দুর্বল হবে। তাই সবাইকে এখনই সচেতন হতে হবে,”—বলেন রিজওয়ানা।
উপসংহার
রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, নির্বাচন আয়োজন শুধু সময় ঘোষণা দিয়ে শেষ করা যায় না। নির্বাচনকে ঘিরে জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে প্রয়োজন প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক সহনশীলতা, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং সর্বোপরি একটি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া। সরকার যদি এই বিষয়গুলো উপেক্ষা করে একতরফাভাবে নির্বাচন করতে চায়, তাহলে তা দেশের গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশের ইতিহাস বলছে—জনগণের আকাঙ্ক্ষা অবদমিত করা গেলেও তা থামানো যায় না। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো যদি সত্যিই দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায়, তবে তাদের মধ্যে সংলাপ ও সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে এখনই।