
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে ৫ নদীবন্দরেও ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে হবে, উপকূলীয় এলাকায় জীবনযাত্রা প্রভাবিত হতে পারে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১৭ জুন, ২০২৫ প্রকাশিত সতর্কবার্তা অনুযায়ী, মৌসুমি বায়ুর তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে উত্তর বঙ্গোপসাগরে বজ্রমেঘ সৃষ্টি হচ্ছে এবং বায়ুচাপের পার্থক্য বেড়ে যাওয়ার ফলে সমুদ্রবন্দরগুলোতে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতসহ দমকা বা ঝোড়ো হাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে “৩ নম্বর” স্থানীয় সতর্ক সংকেত প্রদানে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা সামুদ্রিক যানবাহন ও মৎস্যজীবীদের জন্য এক উচ্চতর বিপদসংকেত।
উল্লেখ্য, আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে যে, সমুদ্রের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ৪৫–৬০ কিমি বেগে অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এর প্রভাবে সমুদ্রের ঢেউ বিপদসীমার আশেপাশে পৌঁছাতে পারে, যা ছোট নৌকা ও ট্রলারের নিরাপদ চলাচলে খরতর পরিস্থিতি তৈরি করবে। তাই উপকূলের কাছাকাছি অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারের মালিক ও চালকদের পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ‘কোড রেড’ মানে সাবধানে ঘাটে অবস্থান বা পোর্টে নিরাপদ স্থলে আশ্রয় গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ।
একই সঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার নদীবন্দরসমূহকে “১ নম্বর” সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এসব এলাকায় দক্ষিণ/দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫–৬০ কিমি বেগে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়া এবং বৃষ্টি/বজ্রবৃষ্টি হতে পারে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ জলপথ ও নদীবন্দরগুলোর কর্মসংস্থান, মাছ ধরা ও যাত্রী পরিবহন ব্যাহত করতে পারে ।
বর্তমান মৌসুমে উপকূলীয় ঝড় এবং বন্যার ঝুঁকি বিবেচনা করে স্থানীয় প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত হুমকি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরগুলোতে আবহাওয়া মোতাবেক লঞ্চ, ফেরি ও ছোট নৌকার চলাচল সীমিত বা বিশেষ অনুমতি-নির্ভর করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মোংলা ও পায়রায় গেরুয়া সতর্ক সংকেত জারি করে নিরাপদ অবস্থানে মাছ ধরার নৌকাগুলো কোয়ার্টারে রাখতে বলা হয়েছে।
তাছাড়া, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত প্রকৌশলীরা সমুদ্রতীরবর্তী বাঁধ, খাল ও নদীতীর রক্ষাবাঁধের অবস্থা পরিদর্শন ও মেরামতের নির্দেশ পেয়েছেন। প্রায়ই ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর পানি বিপদসীমা ও সতর্কসীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার কারণে প্লাবন ঘটেছে; তাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং চালু করা হয়েছে।
উপকূলের চা-দাবি ও লবণ উৎপাদনকারী কমিউনিটির নেতারা গুঁড়ি-লবণ ও চা-পাতা শুকানোর কারিগরদের সতর্ক করেছেন, যাতে তাদের কাজ কেন্দ্রগুলোতে ঝড়ো হাওয়া ও স্থগিত বৃষ্টির সময় নিরাপদ ব্যবস্থা থাকে। কৃষি কর্মকর্তা ও মৎস্য বিভাগ নিয়মিত বৃষ্টিপাতের পর ক্ষেত, খাল ও দিঘীর পানি পরিস্থিতি মনিটর করে দরিদ্র কৃষক ও জেলেদের সহায়তা কর্মসূচি পরিচালনার পরিকল্পনা শুরু করেছে।
জেলার শিক্ষা অফিসারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ঝড়ো হাওয়া ও বজ্রপাতের আশঙ্কায় আজ (১৭ জুন) বিকেলের পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট পেরিয়ে বিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে অস্থায়ী পর্যাপ্ত ছুটি ঘোষণা বা পাঠদান সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার বিষয়টি বিবেচনা করতে। কারণ বজ্রবৈদ্যুতিক ঝড় এবং হিম স্রোতে শিশুদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
সমগ্র পরিস্থিতিতে নৌবাহিনীর মোবাইল ভ্যান ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের সাইকোলজি ইউনিট মাঠ পর্যায়ে আশ্রয়কেন্দ্র ও ত্রাণ বিতরণ কৌশল নির্ধারণে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। উপকূলীয় সফট রিসোর্ট, হোটেল ও পর্যটন শিল্পের জন্য জরুরি হোরিজন সিকিউরিটি প্ল্যান প্রস্তুত করা হয়েছে, যাতে পর্যটকদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়া যায়।
স্থানীয় মানুষকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, হঠাৎ বন্যা, রাস্তা-ঘাটের ধস এবং সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতায় পড়তে পারে। তাই বাড়ি-ঘর ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোতে জলের চলাচলের পথ—যেমন ড্রেন, খাল ও গাটর—পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, সেচ ব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি এড়াতে জলসেচ পাম্প ও পাইপলাইন নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রাখতে বলা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ‘৩ নম্বর’ সতর্ক সংকেত মানে অধিকতর বিপদক্ষণ: হালকা নৌকা বা ট্রলার চলাচল বন্ধ রাখা এবং মাঝারি আকারের জাহাজ অন্যত্র স্থানান্তর করার পরামর্শ। ‘১ নম্বর’ সংকেত মানে অপেক্ষাকৃত হালকা ঝুঁকি, তবে অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোতে পণ্য ও যাত্রী চলাচল সীমিত করার বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, যদি সমুদ্রবন্দর ও নদীবন্দরগুলোতে বৃষ্টি আর তীব্র আকার ধারণ করে, তবে উপকূলবর্তী এলাকা প্লাবিত হতে পারে এবং নিম্নাঞ্চলগুলোতে ক্ষয়ক্ষতি হবে। তাই সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ইউনিটকে জরুরি প্রস্তুতিমূলক মিটিং এবং সিমুলেশন অনুশীলন চালিয়ে যেতে বলা হয়।
বর্তমান আবহাওয়া পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতে স্বল্পমেয়াদে প্রভাব ফেলতে পারে: পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হবে, মৎস্যজাত পন্যের বাজারে সরবরাহ কমে দাম সাময়িকভাবে বাড়তে পারে, এবং কৃষিপণ্য ক্ষেতে জলাবদ্ধতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে, সময়মতো প্রস্তুতি ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিলে মানবিয় ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সর্বশেষ, আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বন্দর কর্তৃপক্ষের বার্তা মেনে আবাসিক ও ব্যবসায়িক সবাইকে সতর্ক থাকতে এবং সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে। সক্রিয় যোগাযোগ মাধ্যমে—টেলিফোন, রেডিও, মোবাইল অ্যালার্ট—নিয়মিত সতর্কতা শেয়ার করা হবে, যাতে সর্বস্তরের জনগণ ঝুঁকির সময় সঠিক তথ্য পেয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এই তীব্র মৌসুমি বায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় সরকার, লজিস্টিক সেক্টর, স্থানীয় প্রশাসন এবং সাধারণ জনতার সমন্বিত প্রস্তুতি ও সচেতনতা অপরিহার্য, যাতে অতি ভারী বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি সর্বনিম্নে আনা যায়।