
ঈদুল আজহার আগাম প্রস্তুতিতে নগদ লেনদেন বেড়েছে, নতুন নোটের চাহিদা তুঙ্গে
ঢাকা শহরের ব্যাংকগুলোতে ঈদুল আজহার ছুটির আগেই নগদ টাকার ব্যাপক চাহিদা দেখা গেছে। দীর্ঘ ছুটির পূর্বে, বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের মধ্যে নগদ অর্থ উত্তোলনের প্রবণতা চোখে পড়ছে ব্যাপকভাবে। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, গৃহিণী থেকে শুরু করে তরুণ তরুণী—প্রত্যেকে যেন ছুটির আগেই নিজেদের আর্থিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে চাইছেন। ফলে ঢাকার বেশিরভাগ ব্যাংকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই উপচে পড়া ভিড়।
ঈদুল আজহা বাংলাদেশের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব, যেখানে পশু কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করে থাকেন। ফলে এই উৎসবের আগে বাজারে এবং সাধারণ মানুষের কাছে নগদের চাহিদা অনেক বেশি হয়ে যায়। একইসাথে ছুটির দীর্ঘসুত্রতা এবং অনিশ্চয়তা সাধারণ মানুষকে আগেভাগেই প্রস্তুতি নিতে বাধ্য করছে।
নগদ উত্তোলন ২৫% পর্যন্ত বেড়েছে
বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকরা জানান, ঈদের ছুটির আগে শেষ কার্যদিবসে প্রতিদিনের তুলনায় প্রায় ২০–২৫ শতাংশ বেশি লেনদেন হয়েছে। বেশিরভাগ গ্রাহকই নগদ উত্তোলন, চেক জমা এবং অনলাইন ট্রান্সফার সংক্রান্ত সেবা নিতে ব্যাংকে আসেন।
একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, “এমন ব্যস্ততা সাধারণত বছরে একবারই দেখা যায়—ঈদুল আজহার আগের সপ্তাহে। মানুষ পশু কিনতে নগদ টাকা তুলছেন, আবার কেউ কেউ ট্রাভেল বা পারিবারিক খরচের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।”
যদিও দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ডিজিটাল লেনদেন ও মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, তবুও কোরবানির সময় নগদের চাহিদা এখনো কমেনি। বিশেষ করে পশুর হাটে ডিজিটাল পেমেন্ট এখনো সর্বজনগ্রাহ্য নয়।
নতুন টাকার প্রতি মানুষের আগ্রহ
ঈদের আরেকটি বিশেষ দিক হলো নতুন টাকার আদান-প্রদান। শিশু থেকে বড় সবাই ঈদের দিনে নতুন টাকা পেতে পছন্দ করে। এই সংস্কৃতির কারণে ব্যাংকগুলোতে নতুন টাকার চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা এবার ২০, ৫০ এবং ১,০০০ টাকার নতুন ডিজাইনের নোট বাজারে ছেড়েছে। তবে ৫, ১০, ১০০, ২০০ এবং ৫০০ টাকার নতুন নোট ঈদের পর ছাপা হবে।
অনেকে অভিযোগ করেছেন যে, ব্যাংকে গেলেও নতুন নোট পাওয়া যাচ্ছে না। এক গ্রাহক বলেন, “আমি তিনটা ব্যাংকে গিয়ে খালি হাতে ফিরেছি। নতুন টাকা পাওয়া এখন ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে গেছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক মুখপাত্র জানান, নতুন নোটের যোগান সীমিত হলেও তারা চেষ্টা করছেন যেন বেশি সংখ্যক গ্রাহক এই সুযোগ পান। এর পাশাপাশি সবাইকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি না করার জন্য।
ডিজিটাল লেনদেনকে উৎসাহ দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময় চায় নগদের বদলে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিতে। বিশেষ করে ঈদের মতো সময়ে যখন লোকসমাগম এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেড়ে যায়, তখন নগদ বহনের ঝুঁকি এড়াতে ডিজিটাল পেমেন্ট সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরেফ হোসেন খান বলেন, “আমরা ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে কোরবানির হাট ও অন্যান্য জায়গায় লেনদেন করার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করছি। এটি নিরাপদ, দ্রুত এবং ঝামেলাবিহীন।”
তবে দেশের কিছু অঞ্চল ও পশুর হাটে এখনো ডিজিটাল অবকাঠামোর অভাব থাকায় মানুষ নগদ টাকাকেই বেশি ভরসা করছেন।
ঈদের সময়সূচি ও ব্যাংকের কার্যক্রম
সরকারি ছুটি অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো ৫ জুন থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। তবে শিল্প এলাকা বা রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট কিছু ব্যাংক শাখা ৫, ১১ এবং ১২ জুন খোলা থাকবে যাতে পোশাক শ্রমিকদের বেতন এবং বোনাস প্রদান নিশ্চিত করা যায়।
এই ব্যবস্থাটি বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ঈদের আগে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা না গেলে উৎপাদন কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।
জনদুর্ভোগও বেড়েছে কিছু ক্ষেত্রে
ব্যাংকে এই চাপের কারণে অনেক গ্রাহককে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। কিছু শাখায় লেনদেনের সময় বাড়িয়ে দেওয়া হলেও তা যথেষ্ট ছিল না। এটিএম বুথগুলোতেও টাকার সরবরাহ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ছিল, ফলে বেশ কিছু বুথে টাকা শেষ হয়ে যায়।
ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে যুক্ত বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরণের চাপ প্রতিবছরই আসছে, তাই ডিজিটাল ও এটিএম ব্যবস্থার সক্ষমতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। একইসাথে গ্রাহকদের সচেতন করা দরকার যাতে তারা একদিনে সবাই এসে ভিড় না করেন।
উপসংহার
ঈদুল আজহা একটি ধর্মীয় উৎসব হলেও এর প্রভাব অর্থনীতির ওপরও পড়ে গভীরভাবে। মানুষের ব্যয়, ব্যাংকিং লেনদেন, নগদের চাহিদা—সব কিছু এই সময়ে বেড়ে যায়। ব্যাংকগুলো এই চাপ সামাল দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে, তবে সামনের বছরগুলোতে ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থার আরও বিস্তার ছাড়া এই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।
এই ঈদে নগদ অর্থ ব্যবস্থাপনায় যারা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছেন, তাদের জন্য স্বস্তি হলেও যারা শেষ মুহূর্তে ব্যাংকে ছুটছেন, তাদের জন্য চাপ এবং ভোগান্তি অনিবার্য হয়ে পড়ছে।